পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 > 8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী কিন্তু, অবকাশ হচ্ছে বিরাটের সিংহাসন । অসীম অবকাশের মধ্যে বিশ্বের প্রতিষ্ঠা । বৃহৎ যেখানে আছে অবকাশ সেখানে ফাকা নয়, একেবারে পরিপূর্ণ। সংসারের মধ্যে যেখানে বৃহৎকে আমরা রাখি নি। সেখানে অবকাশ এমন ফাঁকা ; বিশ্বে যেখানে বৃহৎ বিরাজমান সেখানে অবকাশ এমন গভীরভাবে মনোহর। গায়ে কাপড় না থাকলে মানুষের যেমন লজ্জা সংসারে অৰকাশ আমাদের তেমনি লজ্জা দেয় ; কেননা, ওটা কিনা শূন্য তাই ওকে আমরা বলি জড়তা, আলস্য- কিন্তু, সত্যকার সন্ন্যাসীর পক্ষে অবকাশে লজ্জা নেই, কেননা, তার অবকাশ পূর্ণতা, সেখানে উলঙ্গতা নেই। এ কেমনতরো ? যেমন প্ৰবন্ধ এবং গান ৷ প্ৰবন্ধে কথা যেখানে থামে। সেখানে কেবলমাত্র ফাকা । গানে কথা যেখানে থামে সেখানে সুরে ভরাট । বস্তুত, সুর যতই বৃহৎ হয়, ততই কথার অবকাশ বেশি থাকা চাই। গায়কের সার্থকতা কথার ফাকে, লেখকের সার্থকতা কথার ঝাকে । আমরা লোকালয়ের মানুষ এই যে জাহাজে করে চলছি, এইবার আমরা কিছুদিনের জন্যে বিশ্বের দিকে মুখ ফেরাতে পেরেছি। সৃষ্টির যে পিঠে অনেকের ঠেলাঠেলি ভিড় সেদিক থেকে যে-পিঠে একের আসন সেদিকে এসেছি। দেখতে পাচ্ছি, এই যে নীল আকাশ এবং নীল সমুদ্রের বিপুল অবকাশ এ যেন অমৃতের পূর্ণ ঘট । অমৃত— সে যে শুভ্ৰ আলোর মতো পরিপূর্ণ এক। শুভ্ৰ আলোয় বহুবর্ণচ্ছটা একে মিলেছে, অমৃত্যুরসের তেমনি বহুরস একে নিবিড় । জগতে এই এক আলো যেমন নানাবর্ণে বিচিত্র, সংসারে তেমনি এই এক রসই নানা রসে বিভক্ত । এইজন্যে, অনেককে সত্য করে জানতে হলে সেই এককে সঙ্গে সঙ্গে জানতে হয় । গাছ থেকে যে-ডাল কাটা হয়েছে সে-ডালের ভার মানুষকে বইতে হয় ; গাছে যে-ডাল আছে সে ডাল মানুষের ভার বইতে পারে । এক থেকে বিচ্ছিন্ন যে অনেক তারই ভার মানুষের পক্ষে বোঝা ; একের মধ্যে বিধৃত যে অনেক সেই তো মানুষকে সম্পূর্ণ আশ্রয় দিতে পারে। সংসারে একদিকে আবশ্যকের ভিড়, অন্যদিকে অনাবশ্যকের । আবশ্যকের দায় আমাদের বহন করতেই হৰে, তাতে আপত্তি করলে চলবে না । যেমন ঘরে থাকতে হলে দেয়াল না হলে চলে না, এও তেমনি । কিন্তু সবটাই তো দেয়াল নয় । অন্তত খানিকটা করে জানলা থাকে, সেই ফাক দিয়ে আমরা আকাশের সঙ্গে আত্মীয়তা রক্ষা করি। কিন্তু, সংসারে দেখতে পাই, লোকে ঐ জানলাটুকু সইতে পারে না। ঐ ফাকটুকু ভরিয়ে দেবার জন্যে যতরকম সাংসারিক অনাবশ্যকের সৃষ্টি । ঐ জানলাটার উপর বাজে কাজ, বাজে চিঠি, বাজে সভা, বাজে বক্তৃতা, বাজে হাসফাস মেরে দিয়ে দশে মিলে ঐ ফাকটাকে একেবারে বুজিয়ে ফেলা হয় । নারকেলের ছিবড়ের মতো, এই অনাবশ্যকের পরিমাণটাই বেশি ।। ঘরে” বাইরে, ধর্মে কর্মে, আমোদে আহলাদে, সকল বিষয়েই এরই অধিকার সবচেয়ে বড়ো ; এর কাজই হচ্ছে ফাক বুজিয়ে বেড়ানো । কিন্তু, কথা ছিল ফাক বোজাব না, কেননা, ফাকের ভিতর দিয়ে ছাড়া পূর্ণকে পাওয়া যায় না। ফাকের ভিতর দিয়েই আলো আসে, হাওয়া আসে। কিন্তু, আলো হাওয়া আকাশ যে মানুষের তৈরি জিনিস নয়, তাই লোকালয় পারতপক্ষে তাদের জন্যে জায়গা রাখতে চায় না- তাই আবশ্যক বাদে যেটুকু নিরালা থাকে সেটুকু অনাবশ্যক দিয়ে ঠেসে ভরতি করে দেয়। এমনি করে মানুষ আপনার দিনগুলোকে তো নিরেট করে তুলেইছে, রাত্রিটাকেও যতখানি পারে ভরাট করে দেয় । ঠিক যেন কলকাতার মনিসিপ্যালিটির আইন। যেখানে যত পুকুর আছে বুজিয়ে ফেলতে হবে, রাবিশ দিয়ে হােক, যেমন করে হােক। এমন-কি, গঙ্গাকেও যতখানি পারা যায় পুল-চাপা, জেটি-চাপ, জাহাজ-চাপা দিয়ে গলা টিপে মারবার চেষ্টা । ছেলেবেলাকার কলকাতা মনে পড়ে ; ঐ পুকুরগুলোই ছিল আকাশের স্যাঙাত, শহরের মধ্যে ঐখানটাতে দুলোেক এই ভুলোকে একটুখানি পা ফেলবার জায়গা পেত, ঐখানেই আকাশের আলোকের আতিথ্য করবার জন্য পৃথিবী আপন জলের আসনগুলি পেতে রেখেছিল । আবশ্যকের একটা সুবিধা এই যে তার একটা সীমা আছে। সে সম্পূর্ণ বেতালা হতে পারে না ; সে দশটা-চারটেকে স্বীকার করে, তার পার্বণের ছুটি আছে, সে রবিবারকে মানে, পারতপক্ষে রাত্রিকে সে