পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জাপান-যাত্রী 8२७ জাপানিকে বোঝা যায় না, ওরা অত্যন্ত বেশি গৃঢ় । এর কারণই হচ্ছে, এরা নিজেকে সর্বদা ফুটাে দিয়ে ফাক দিয়ে গ’লে পড়তে দেয় না । এই যে নিজের প্রকাশকে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত করতে থাকা, এ ওদের কবিতাতেও দেখা যায় । তিন লাইনের কাব্য জগতের আর কোথাও নেই। এই তিন লাইনই ওদের কবি, পাঠক, উভয়ের পক্ষেই । যথেষ্ট । সেইজন্যেই এখানে এসে অবধি, রাস্তায় কেউ গান গাচ্ছে, এ আমি শুনি নি । এদের হৃদয় ঝরনার জলের মতো শব্দ করে না, সরোবরের জলের মতো স্তন্ধ । এপর্যন্ত ওদের যত কবিতা শুনেছি সবগুলিই হচ্ছে ছবি দেখার কবিতা, গান গাওয়ার কবিতা নয় । হৃদয়ের দাহ এবং ক্ষোভ প্ৰাণকে খরচ করে, এদের সেই খরচ কম । এদের অন্তরের সমস্ত প্ৰকাশ সৌন্দর্যবোধে । সৌন্দর্যবোধ জিনিসটা স্বার্থনিরপেক্ষ । ফুল, পাখি, চাদ, এদের নিয়ে আমাদের কাদাকাটা নেই। এদের সঙ্গে আমাদের নিছক সৌন্দর্যভোগের সম্বন্ধ- এরা আমাদের কোথাও মারে না, কিছু কাড়ে না, এদের দ্বারা আমাদের জীবনে কোথাও ক্ষয় ঘটে না । সেইজন্যেই তিন লাইনেই এদের কুলোয়, এবং কল্পনাটাতেও এরা শান্তির ব্যাঘাত করে না । এদের দুটাে বিখ্যাত পুরোনো কবিতার নমুনা দেখলে আমার কথাটা স্পষ্ট হবে : ব্যাঙের লাফ, জলের শবদ । বাস । আর দরকার নেই। জাপানি পাঠকের মনটা চোখে ভরা । পুরোনো পুকুর মানুষের পরিত্যক্ত, নিস্তব্ধ, অন্ধকার । তার মধ্যে একটা ব্যাঙ লাফিয়ে পড়তেই শব্দটা শোনা গেল । শোনা গেলা— এতে বোঝা যাবে পুকুরটা কী রকম স্তব্ধ। এই পুরোনো পুকুরের ছবিটা কী ভাবে মনের মধ্যে ঐকে নিতে হবে সেইটুকু কেবল কবি ইশারা করে দিলে ; তার বেশি একেবারে অনাবশ্যক । পচা ডাল, একটা কাক, শরৎকাল । আর বেশি না ! শরৎকালে গাছের ডালে পাতা নেই, দুই-একটা ডাল পচে গেছে, তার উপরে কাক বসে। শীতের দেশে শরৎকালটা হচ্ছে গাছের পাতা ঝরে যাবার, ফুল পড়ে যাবার, কুয়াশায় আকাশ স্নান হবার কাল- এই কালটা মৃত্যুর ভাব মনে আনে। পচা ডালে কালো কাক বসে আছে, এইটুকুতেই পাঠক শরৎকালের সমস্ত রিক্ততা ও মানতার ছবি মনের সামনে দেখতে পায় । কবি কেবল সূত্রপাত করে দিয়েই সরে দাঁড়ায় । তাকে যে অত অল্পের মধ্যেই সরে যেতে হয় তার কারণ এই যে, জাপানি পাঠকের চেহারা দেখার মানসিক শক্তিটা প্ৰবল । এইখানে একটা কবিতার নমুনা দিই, যেটা চোখে দেখার চেয়ে বড়ো : স্বৰ্গ এবং মর্ত হচ্ছে ফুল, দেবতারা এবং বুদ্ধ হচ্ছেন ফুল মানুষের হৃদয় হচ্ছে ফুলের অন্তরাত্মা। আমার মনে হয়, এই কবিতাটিতে জাপানের সঙ্গে ভারতবর্ষের মিল হয়েছে । জাপান স্বৰ্গমর্তকে বিকশিত ফুলের মতো সুন্দর করে দেখছে ; ভারতবর্ষ বলছে, এই যে এক বৃন্তে দুই ফুল, স্বৰ্গ এবং মর্ত, দেবতা এবং বুদ্ধ— মানুষের হৃদয় যদি না থাকত। তবে এ ফুল কেবলমাত্র বাইরের জিনিস হতএই সুন্দরের সৌন্দর্যটিই হচ্ছে মানুষের হৃদয়ের মধ্যে ।