পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

डा०ान-याईी 8之@ করছে। একটিমাত্র ছবি কিংবা একটিমাত্র পাত্ৰ কোথাও আছে। নিমন্ত্রিতেরা সেইটি বহু যত্নে দেখে দেখে নীরবে তৃপ্তিলাভ করেন । যে-জিনিস। যথার্থ সুন্দর তার চারি দিকে মস্ত একটি বিরলতার অবকাশ থাকা চাই । ভালো জিনিসগুলিকে ঘেঁষাৰ্ঘেষি করে রাখা তাদের অপমান করা- সে যেন সতী স্ত্রীকে সতীনের ঘর করতে দেওয়ার মতো । ক্ৰমে ক্রমে অপেক্ষা করে করে, স্তৱন্ধতা ও নিঃশব্দতার দ্বারা মনের ক্ষুধাকে জাগ্রত করে তুলে, তার পরে এইরকম দুটি-একটি ভালো জিনিস দেখালে সে যে কী উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, এখানে এসে তা স্পষ্ট বুঝতে পারলুম। আমার মনে পড়ল, শান্তিনিকেতন আশ্রমে যখন আমি এক-একদিন এক-একটি গান তৈরি করে সকলকে শোনাতুম, তখন সকলেরই কাছে সেই গান তার হৃদয় সম্পূর্ণ উদঘাটিত করে দিত । অথচ সেই সব গানকেই তোড়া বেঁধে কলকাতায় এনে যখন বান্ধবসভায় ধরেছি, তখন তারা আপনার যথার্থ শ্ৰীকে আবৃত করে রেখেছে । তার মানেই কলকাতার বাড়িতে গানের চারি দিকে ফাকা নেই- সমস্ত লোকজন, ঘরবাড়ি কাজকর্ম, গোলমাল, তার ঘাড়ের উপর গিয়ে পড়েছে। যে-আকাশের মধ্যে তার ঠিক অর্থটি বোঝা যায়, সেই আকাশ নেই । তার পরে গৃহস্বামী এসে বললেন, চা তৈরি এবং পরিবেশনের ভার বিশেষ কারণে তিনি তার মেয়ের উপরে দিয়েছেন । র্তার মেয়ে এসে নমস্কার করে চা তৈরিতে প্ৰবৃত্ত হলেন । তার প্রবেশ থেকে আরম্ভ করে চা তৈরির প্রত্যেক অঙ্গ যেন কবিতার ছন্দের মতো । ধোওয়া মোছা, আগুন জ্বালা, চা-দানির ঢাকা খোলা, গরম জলের পাত্র নামানো, পেয়ালায় চা ঢালা, অতিথির সম্মুখে এগিয়ে দেওয়া, সমস্ত এমন সংযম এবং সৌন্দর্যে মণ্ডিত যে, সে না দেখলে বোঝা যায় না । এই চা-পানের প্রত্যেক আসবাবটি দুর্লভ এবং সুন্দর । অতিথির কর্তব্য হচ্ছে, এই পাত্রগুলিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একান্ত মনোযোগ দিয়ে দেখা । প্ৰত্যেক পাত্রের স্বতন্ত্র নাম এবং ইতিহাস । কত যে তার যত্ন, সে বলা যায় । | | সমস্ত ব্যাপারটা এই । শরীরকে মনকে একান্ত সংযত করে নিরাসক্ত প্ৰশান্ত মনে সৌন্দর্যকে নিজের প্রকৃতির মধ্যে গ্ৰহণ করা । ভোগীর ভোগোন্মাদ নয় ; কোথাও লেশমাত্র উচ্ছঙ্খলতা বা অমিতাচার নেই ; মনের উপরতলায় সর্বদা যেখানে নানা স্বার্থের আঘাতে, নানা প্ৰয়োজনের হাওয়ায়, কেবলই ঢেউ উঠছে, তার থেকে দূরে সৌন্দর্যের গভীরতার মধ্যে নিজেকে সমাহিত করে দেওয়াই হচ্ছে এই ৷ চা-পান অনুষ্ঠানের তাৎপর্য । এর থেকে বোঝা যায়, জাপানের যে-সৌন্দর্যবোধ সে তার একটা সাধনা, একটা প্ৰবল শক্তি । বিলাস জিনিসটা অন্তরে বাহিরে কেবল খরচ করায়, তাতেই দুর্বল করে । কিন্তু, বিশুদ্ধ সৌন্দর্যবোধ মানুষের মনকে স্বাৰ্থ এবং বস্তুর সংঘাত থেকে রক্ষা করে । সেইজন্যেই জাপানির মনের এই সৌন্দর্যরসবোধ পৌরুষের সঙ্গে মিলিত হতে পেরেছে । এই উপলক্ষে আর-একটি কথা বলবার আছে। এখানে মেয়ে-পুরুষের সামীপ্যের মধ্যে কোনো গ্লানি দেখতে পাই নে ; অন্যত্র মেয়ে-পুরুষের মাঝখানে যে একটা লজা-সংকোচের আবিলতা আছে, এখানে তা নেই । মনে হয়, এদের মধ্যে মোহের একটা আবরণ যেন কম । তার প্রধান কারণ, জাপানে স্ত্রী-পুরুষেরা একত্রে বিবস্ত্র হয়ে স্নান করার প্রথা আছে। এই প্রথার মধ্যে যে লেশমাত্র কলুষ নেই তার প্রমাণ এই— নিকটতম আত্মীয়েরাও এতে মনে কোনো বাধা অনুভব করে না । এমনি করে এখানে স্ত্রী পুরুষের দেহ পরস্পরের দৃষ্টিতে কোনো মায়াকে পালন করে না । দেহ সম্বন্ধে উভয় পক্ষের মন খুব স্বাভাবিক । অন্য দেশের কলুষদৃষ্টি ও দুষ্টবুদ্ধির খাতিরে আজকাল শহরে এই নিয়ম উঠে যাচ্ছে। কিন্তু, পাড়াগায়ে এখনো এই নিয়ম চলিত আছে। পৃথিবীতে যত সভ্য দেশ আছে তার মধ্যে কেবল জাপান মানুষের দেহ সম্বন্ধে যে মোহমুক্ত, এটা আমার কাছে খুব একটা বড়ো জিনিস বলে মনে হয় । অথচ আশ্চর্য এই যে, জাপানের ছবিতে উলঙ্গ স্ত্রীমূর্তি কোথাও দেখা যায় না । উলঙ্গতার গোপনীয়তা ওদের মনে রহস্যজাল বিস্তার করে নি বলেই এটা সম্ভবপর হয়েছে। আরো একটা জিনিস দেখতে পাই। এখানে মেয়েদের কাপড়ের মধ্যে নিজেকে স্ত্রীলোক বলে বিজ্ঞাপন দেবার