পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জাপান-যাত্রী 8ਐ রসিকের মধ্যেই রূপারসের যে-বোধ দেখতে পাওয়া যায় এ দেশে সমস্ত জাতের মধ্যে তাই ছড়িয়ে পড়েছে। যুরোপে সর্বজনীন বিদ্যাশিক্ষা আছে, সর্বজনীন সৈনিকতার চর্চাও সেখানে অনেক জায়গায় প্রচলিত, কিন্তু এমনতরো সর্বজনীন রসবোধের সাধনা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এখানে দেশের সমস্ত লোক সুন্দরের কাছে আত্মসমৰ্পণ করেছে। তাতে কি এরা বিলাসী হয়েছে। অকৰ্মণ্য হয়েছে ? জীবনের কঠিন সমস্যা ভেদ করতে এরা কি উদাসীন কিংবা অক্ষম হয়েছে।— ঠিক তার উলটাে ২ এরা এই সৌন্দর্যসাধনা থেকেই মিতাচার শিখেছে, এই সৌন্দর্যসাধনা থেকেই এরা বীৰ্য এবং কমনৈপুণ্য লাভ করেছে । আমাদের দেশে একদল লোক আছে তারা মনে করে, শুষ্কতাই বুঝি পৌরুষ, এবং কর্তব্যের পথে চলাবার সদুপায় হচ্ছে রসের উপবাস- তারা জগতের আনন্দকে মুড়িয়ে ফেলাকেই জগতের ভালো করা মনে করে । য়ুরোপে যখন গেছি তখন তাদের কলকারখানা, তাদের কাজের ভিড়, তাদের ঐশ্বর্য এবং প্রতাপ খুব করে চোখে পড়েছে এবং মনকে অভিভূত করেছে। তবু, “এহ বাহ্য।” । কিন্তু, জাপানে আধুনিকতার ছদ্মবেশ ভেদ করে যা চোখে পড়ে, সে হচ্ছে মানুষের হৃদয়ের সৃষ্টি । সে অহংকার নয়, আড়ম্বর নয়, সে পূজা। প্রতাপ নিজেকে প্রচার করে ; এইজন্যে যতদূর পারে বস্তুর আয়তনকে বাড়িয়ে তুলে আর-সমস্তকে তার কাছে নত করতে চায় । কিন্তু, পূজা আপনার চেয়ে বড়োকে প্রচার করে, এইজন্যে তার আয়োজন সুন্দর এবং খাটি, কেবলমাত্র মস্ত এবং অনেক নয় । জাপান আপনার ঘরে বাইরে সর্বত্র সুন্দরের কাছে আপনি অর্ঘ্য নিবেদন করে দিচ্ছে। এ দেশে আসবামাত্ৰ সকলের চেয়ে বড়ো বাণী যা কানে এসে পৌছয় সে হচ্ছে, “আমার ভালো লাগল, আমি ভালোবাসলুম।” এই কথাটি দেশসুদ্ধ সকলের মনে উদয় হওয়া সহজ নয়, এবং সকলের বাণীতে প্ৰকাশ হওয়া আরো শক্ত । এখানে কিন্তু প্ৰকাশ হয়েছে । প্ৰত্যেক ছোটো জিনিসে, ছোটো ব্যবহারে সেই আনন্দের পরিচয় পাই। সেই আনন্দ ভোগের আনন্দ নয়, পূজার আনন্দ । সুন্দরের প্রতি এমন আন্তরিক সম্রাম অন্য কোথাও দেখি নি । এমন সাবধানে, যত্নে, এমন শুচিত রক্ষা করে সৌন্দর্যের সঙ্গে ব্যবহার করতে অন্য কোনো জাতি শেখে নি । যা এদের ভালো লাগে তার সামনে এরা শব্দ করে না । সংযমই প্রচুরতার পরিচয় এবং স্তব্ধতাই গভীরতাকে প্রকাশ করে, এরা সেটা অস্তরের ভিতর থেকে বুঝেছে । এবং এরা বলে, সেই আন্তরিক বোধশক্তি এরা বৌদ্ধধর্মের সাধনা থেকে পেয়েছে । এরা স্থির হয়ে শক্তিকে নিরোধ করতে পেরেছে বলেই সেই অক্ষুন্ন শক্তি এদের দৃষ্টিকে বিশুদ্ধ এবং বোধকে উজ্জ্বল করে তুলেছে । পূর্বেই বলেছি, প্ৰতাপের পরিচয়ে মন অভিভূত হয়, কিন্তু এখানে যে পূজার পরিচয় দেখি তাতে মন অভিভবের অপমান অনুভব করে না । মন আনন্দিত হয়, ঈৰ্ষান্বিত হয় না। কেননা, পূজা যে আপনার চেয়ে বড়োকে প্রকাশ করে, সেই বড়োর কাছে সকলেই আনন্দমনে নত হতে পারে, মনে কোথাও বাজে না । দিল্লিতে যেখানে প্রাচীন হিন্দুরাজার কীর্তিকলার বুকের মাঝখানে কুতুবমিনার অহংকারের মূষলের মতো খাড়া হয়ে আছে সেখানে সেই ঔদ্ধতা মানুষের মনকে পীড়া দেয়, কিংবা কাশীতে যেখানে হিন্দুর পূজাকে অপমানিত করবার জন্যে আরঙজীব মসজিদ স্থাপন করেছে সেখানে না দেখি শ্ৰীকে, না দেখি কল্যাণকে । কিন্তু, যখন তাজমহলের সামনে গিয়ে দাড়াই তখন এ তর্ক মনে আসে না যে, এটা হিন্দুর কীর্তি না মুসলমানের কীর্তি। তখন একে মানুষের কীর্তি বলেই হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করি । জাপানের যেটা শ্রেষ্ঠ প্ৰকাশ সেটা অহংকারের প্রকাশ নয়, আত্মনিবেদনের প্রকাশ, সেইজন্যে এই প্রকাশ মানুষকে আহবান করে, আঘাত করে না । এইজন্যে জাপানে যেখানে এই ভাবের বিরোধ দেখি সেখানে মনের মধ্যে বিশেষ পীড়া বোধ করি । চীনের সঙ্গে নীেযুদ্ধে জাপান জয়লাভ করেছিলসেই জয়ের চিহ্নগুলিকে কঁাটার মতো দেশের চার দিকে পুঁতে রাখা যে বর্বরতা, সেটা যে অসুন্দর, সে কথা জাপানের বােঝা উচিত ছিল। প্রয়ােজনের খাতিরে অনেক ক্রুর কর্ম মানুষকে করতে হয়, কিন্তু সেগুলোকে ভুলতে পারাই মনুষ্যত্ব । মানুষের যা চিরস্মরণীয়, যার জন্যে মানুষ মন্দির করে, মঠ করে,