পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জাপান-যাত্রী 8 ՓՎ9 এমন আরো অনেককে দেখেছি । যে-জাতির মধ্যে বর্ণসংকরতা খুব বেশি ঘটেছে তার মনটা এক ছাচে ঢালাই হয়ে যায় না। প্রকৃতিবৈচিত্র্যের সংঘাতে তার মনটা চলনশীল হয়ে থাকে। এই চলনশীলতায় মানুষকে অগ্রসর করে, এ কথা বলাই বাহুল্য । রক্তের অবিমিশ্রতা কোথাও যদি দেখতে চাই, তা হলে বর্বর জাতির মধ্যে যেতে হয় । তারা পরকে ভয় করেছে, তারা অল্পপরিসর আশ্রয়ের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের জাতকে স্বতন্ত্র রেখেছে। তাই, আদিম অস্ট্রেলিয় জাতির আদিমতা আর ঘুচল না ; আফ্রিকার মধ্যদেশে কালের গতি বন্ধ বললেই হয় । কিন্তু, গ্ৰীস পৃথিবীর এমন একটা জায়গায় ছিল যেখানে এক দিকে এশিয়া, এক দিকে ইজিপ্ট, এক দিকে যুরোপের মহাদেশ তার সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে তাকে আলোড়িত করেছে। গ্ৰীকেরা অবিমিশ্র জাতি ছিল না, রোমকেরাও না । ভারতবর্ষেও অনার্যে আর্যে যে মিশ্রণ ঘটেছিল। সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নেই । জাপানিকেও দেখলে মনে হয়, তারা এক ধাতুতে গড়া নয়। পৃথিবীর অধিকাংশ জাতিই মিথ্যা করেও আপনার রক্তের অবিমিশ্রতা নিয়ে গর্ব করে ; জাপানের মনে এই অভিমান কিছুমাত্র নেই। জাপানিদের সঙ্গে ভারতীয় জাতির মিশ্রণ হয়েছে, এ কথার আলোচনা তাদের কাগজে দেখেছি, এবং তা নিয়ে কোনো পাঠক কিছুমাত্র বিচলিত হয় নি । শুধু তাই নয়, চিত্ৰকলা প্ৰভৃতি সম্বন্ধে ভারতবর্ষের কাছে তারা যে ঋণী সে কথা আমরা একেবারেই ভুলে গেছি, কিন্তু জাপানিরা এই ঋণ স্বীকার করতে কিছুমাত্র কুঠিত হয় না । বস্তুত, ঋণ তারাই গোপন করতে চেষ্টা করে- ঋণ যাদের হাতে ঋণই রয়ে গেছে, ধন হয়ে ওঠে। নি। ভারতের কাছ থেকে জাপান যদি কিছু নিয়ে থাকে সেটা সম্পূর্ণ তার আপনি সম্পত্তি হয়েছে। যে-জাতির মনের মধ্যে চলন-ধর্ম প্রবল সেই জাতিই পরের সম্পদকে নিজের সম্পদ করে নিতে পারে । যার মন স্থাবর, বাইরের জিনিস তার পক্ষে বিষম ভার হয়ে ওঠে ; কারণ, তার নিজের অচল অস্তিত্বই তার পক্ষে প্ৰকাণ্ড একটা বোঝা । কেবলমাত্র জাতিসংকরতা নয়, স্থানসংকীর্ণতা জাপানের পক্ষে একটা মস্ত সুবিধা হয়েছে । ছোটাে জায়গাটি সমস্ত জাতির মিলনের পক্ষে পািটপাকের কাজ করেছে। বিচিত্র উপকরণ ভালোরকম করে গলে মিশে বেশ নিবিড় হয়ে উঠেছে । চীন বা ভারতবর্ষের মতো বিস্তীর্ণ জায়গায় বৈচিত্ৰ্য কেবল বিভক্ত হয়ে উঠতে চেষ্টা করে, সংহত হতে চায় না । প্রাচীনকালে গ্ৰীস রোম এবং আধুনিক কালে ইংলন্ড সংকীর্ণ স্থানের মধ্যে সম্মিলিত হয়ে বিস্তীর্ণ স্থানকে অধিকার করতে পেরেছে । আজকের দিনে এশিয়ার মধ্যে জাপানের সেই সুবিধা । এক দিকে তার মানসপ্রকৃতির মধ্যে চিরকালই চলনধর্ম আছে, যে জন্য চীন কোরিয়া প্রভৃতি প্রতিবেশীর কাছ থেকে জাপান তার সভ্যতার সমস্ত উপকরণ অনায়াসে আত্মসাৎ করতে পেরেছে ; আর-এক দিকে অল্পপরিসর জায়গায় সমস্ত জাতি অতি সহজেই এক ভাবে ভাবিত, এক প্ৰাণে অনুপ্রাণিত হতে পেরেছে। তাই যে-মুহুর্তে জাপানের মস্তিষ্কের মধ্যে এই চিন্তা স্থান পেলে যে আত্মরক্ষার জন্যে যুরোপের কাছ থেকে তাকে দীক্ষা গ্ৰহণ করতে হবে সেই মুহুর্তে জাপানের সমস্ত কলেবরের মধ্যে অনুকুল চেষ্টা জাগ্রত হয়ে উঠল । য়ুরোপের সভ্যতা একান্তভাবে জঙ্গম মনের সভ্যতা, তা স্থাবর মনের সভ্যতা নয় । এই সভ্যতা ক্রমাগতই নূতন চিন্তা, নূতন চেষ্টা, নূতন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে বিপ্লব তরঙ্গের চূড়ায় চুড়ায় পক্ষবিস্তার করে উড়ে চলেছে। এশিয়ার মধ্যে একমাত্র জাপানের মনে সেই স্বাভাবিক চলনধর্ম থাকাতেই জাপান সহজেই যুরোপের ক্ষিপ্ৰতালে চলতে পেরেছে এবং তাতে করে তাকে প্রলয়ের আঘাত সইতে হয় নি । কারণ, উপকরণ সে যা-কিছু পাচ্ছে তার দ্বারা সে সৃষ্টি করছে ; সুতরাং নিজের বর্ধিষ্ণু জীবনের সঙ্গে এ-সমস্তকে সে মিলিয়ে নিতে পারছে। সেই সমস্ত নতুন জিনিস যে তার মধ্যে কোথাও কিছু বাধা