পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

898 রবীন্দ্র-রচনাবলী পাচ্ছে না, তা নয়, কিন্তু সচলতার বেগেই সেই বাধা ক্ষয় হয়ে চলেছে। প্ৰথম প্ৰথম যা অসংগত অদ্ভুত হয়ে দেখা দিচ্ছে ক্ৰমে ক্রমে তার পরিবর্তন ঘটে সুসংগতি জেগে উঠছে। একদিন যে-অনাবশ্যককে সে গ্রহণ করেছে আর-একদিন সেটাকে ত্যাগ করছে ; একদিন যে আপন জিনিসকে পরের হাটে সে খুইয়েছে আর-একদিন সেটাকে আবার ফিরে নিচ্ছে। এই তার সংশোধনের প্রক্রিয়া এখনো নিত্য তার মধ্যে চলছে। যে-বিকৃতি মৃত্যুর তাকেই ভয় করতে হয় ; যে-বিকৃতি প্ৰাণের লীলাবৈচিত্র্যে হঠাৎ এক-এক সময়ে দেখা দেয়। প্ৰাণ আপনি তাকে সামলে নিয়ে নিজের সমে এসে দাড়াতে পারে । আমি যখন জাপানে ছিলুম তখন একটা কথা বার বার আমার মনে এসেছে। আমি অনুভব করছিলুম, ভারতবর্ষের মধ্যে বাঙালির সঙ্গে জাপানির এক জায়গায় যেন মিল আছে। আমাদের এই বৃহৎ দেশের মধ্যে বাঙালিই সব প্রথমে নূতনকে গ্রহণ করেছে, এবং এখনো নূতনকে গ্রহণ ও উদ্ভাবন করবার মতো তার চিত্তের নমনীয়তা আছে । তার একটা কারণ, বাঙালির মধ্যে রক্তের অনেক মিশল ঘটেছে ; এমন, মিশ্রণ ভারতের আর কোথাও হয়েছে কিনা সন্দেহ । তার পরে, বাঙালি ভারতের যে প্ৰান্তে বাস করে সেখানে বহুকাল ভারতের অন্য প্রদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে । বাংলা ছিল পাণ্ডববর্জিত দেশ । বাংলা একদিন দীর্ঘকাল বৌদ্ধপ্ৰভাবে অথবা অন্য যে কারণেই হােক আচারভ্ৰষ্ট হয়ে নিতান্ত একঘরে হয়েছিল, তাতে করে তার একটা সংকীর্ণ স্বাতন্ত্র্য ঘটেছিল ; এই কারণেই বাঙালির চিত্ত অপেক্ষাকৃত বন্ধনমুক্ত, এবং নূতন শিক্ষা গ্ৰহণ করা বাঙালির পক্ষে যত সহজ হয়েছিল এমন ভারতবর্ষের অন্য কোনো দেশের পক্ষে হয় নি। যুরোপীয় সভ্যতার পূর্ণ দীক্ষা জাপানের মতো আমাদের পক্ষে অবাধ নয় ; পরের কৃপণ হস্ত থেকে আমরা যেটুকু পাই তার বেশি আমাদের পক্ষে দুর্লভ। কিন্তু, য়ুরোপীয় শিক্ষা আমাদের দেশে যদি সম্পূর্ণ সুগম হত তা হলে কোনো সন্দেহ নেই, বাঙালি সকল দিক থেকেই তা সম্পূর্ণ আয়ত্ত করত। আজ নানা দিক থেকে বিদ্যাশিক্ষা আমাদের পক্ষে ক্রমশই দুর্মুল্য হয়ে উঠছে, তবু বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকীর্ণ প্রবেশদ্বারে বাঙালির ছেলে প্রতিদিন মাথা খোড়াখুড়ি করে মরছে। বস্তুত, ভারতের অন্য সকল প্রদেশের চেয়ে বাংলাদেশে যে-একটা অসন্তোষের লক্ষণ অত্যন্ত প্ৰবল দেখা যায় তার একমাত্র কারণ, আমাদের প্রতিহত গতি । যা কিছু ইংরেজি তার দিকে বাঙালির উদবোধিত চিত্ত একান্ত প্রবলবেগে ছুটেছিল ; ইংরেজের অত্যন্ত কাছে যাবার জন্যে আমরা প্রস্তুত হয়েছিলুম- এ সম্বন্ধে সকল রকম সংস্কারের বাধা লঙঘন করবার জন্যে বাঙালিই সর্বপ্ৰথমে উদ্যত হয়ে উঠেছিল । কিন্তু, এইখানে ইংরেজের কাছেই যখন বাধা পেল তখন বাঙালির মনে যে প্ৰচণ্ড অভিমান জেগে৷ উঠল সেটা হচ্ছে তার অনুরাগেরই বিকার । এই অভিমানই আজ নবযুগের শিক্ষাকে গ্ৰহণ করবার পক্ষে বাঙালির মনে সকলের চেয়ে বড়ো অন্তরায় হয়ে উঠেছে। আজ আমরা যে-সকল কুটতর্ক ও মিথ্যা যুক্তি দ্বারা পশ্চিমের প্রভাবকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করবার চেষ্টা করছি সেটা আমাদের স্বাভাবিক নয়। এইজন্যেই সেটা এমন সুতীব্ৰ, সেটা ব্যাধির প্রকোপের মতো পীড়ার দ্বারা এমন করে আমাদের সচেতন করে তুলেছে। বাঙালির মনের এই প্ৰবল বিরোধের মধ্যেও তার চলনধর্মই প্ৰকাশ পায় । কিন্তু, বিরোধ কখনো কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। বিরোধে দৃষ্টি কলুষিত ও শক্তি বিকৃত হয়ে যায়। যত বড়ো বেদনাই আমাদের মনে থাক, এ কথা আমাদের ভুললে চলবে না যে, পূর্ব ও পশ্চিমের মিলনের সিংহদ্বার উদঘাটনের ভার বাঙালির উপরেই পড়েছে। এইজন্যেই বাংলার নবযুগের প্রথম পথপ্রবর্তক রামমোহন রায় । পশ্চিমকে সম্পূর্ণ গ্ৰহণ করতে তিনি ভীরুতা করেন নি, কেননা, পূর্বের প্রতি র্তার শ্রদ্ধা অটল ছিল । তিনি যে-পশ্চিমকে দেখতে পেয়েছিলেন সে তো শস্ত্ৰধারী পশ্চিম নয়, বাণিজ্যজীবী পশ্চিম নয়, সে হচ্ছে জ্ঞানে-প্ৰাণে-উদ্ভাসিত পশ্চিম । জাপান য়ুরোপের কাছ থেকে কর্মের দীক্ষা আর অন্ত্রের দীক্ষা গ্ৰহণ করেছে। তার কাছ থেকে বিজ্ঞানের শিক্ষাও সে লাভ করতে বসেছে। কিন্তু, আমি যতটা দেখেছি তাতে আমার মনে হয়,