পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী SR SR NSD সময়টা সুসময়, কিন্তু বাণকারের পক্ষে নয় । ওস্তাদ হাত জোড় করে বলে, “তোমাদের হট্টগোলের কাজে আমার স্থান নেই ; অতএব বরঞ্চ আমি চুপ করে থাকতে রাজি আছি, বীণাটা গলায় বেঁধে জলে ঝাপ দিয়ে পড়ে মরতেও রাজি আছি, কিন্তু আমাকে তোমাদের সদর রাস্তায় গড়ের বাদ্যের দলে ডেকো না । কেননা, আমার উপরওয়ালার কাছ থেকে তার গানের আসরের জন্যে পূর্ব হতেই বায়না পেয়ে বসে আছি ।” এতে জনসাধারণ নানাপ্রকার কটু সম্ভাষণ করে, সে বলে, “তুমি লোকহিত মান না, দেশহিত মান না, কেবল আপনি খেয়ালকেই মান ।” বীণকার বলতে চেষ্টা করে, “আমি আমার খেয়ালকেও মানি নে, তোমার গরজকেও মানি নে, আমার উপরওয়ালাকে মানি ।” সহস্রািরসনাধারী গর্জন করে বলে ওঠে, “চুপ ?” জনসাধারণ বলতে যে প্ৰকাণ্ড জীবকে বোঝায় স্বভাবতই তার প্রয়োজন প্রবল এবং প্রভূত । এইজন্যে স্বভাবতই প্রয়ােজনসাধনের দাম তার কাছে অনেক বেশি, লীলাকে সে অবজ্ঞা করে ; ক্ষুধার সময়ে বকুলের চেয়ে বার্তাকুর দাম বেশি হয় । সেজন্যে ক্ষুধাতুরকে দোষ দিই নে ? কিন্তু বকুলকে যখন বার্তাকুর পদ গ্রহণ করবার জন্যে ফরমাশ আসে তখন সেই ফরমাশকেই দোষ দিই । বিধাতা ক্ষুধাতুরের দেশেও বকুল ফুটিয়েছেন, এতে বকুলের কোনো হাত নেই। তার একটিমাত্র দায়িত্ব আছে এই যে, যেখানে যা-ই ঘটুক, তাকে কারও দরকার থাক বা না থাক, তাকে বকুল হয়ে উঠতেই হবে ; ঝরে পড়ে তো পড়বে, মালায় গাথা হয় তো তা-ই সই। এই কথাটাকেই গীতা বলেছেন, “স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরীধর্মে ভয়াবহঃ !” দেখা গেছে, স্বধর্মে জগতে খুব মহৎ লোকেরও নিধন হয়েছে, কিন্তু সে নিধন বাইরের, স্বধর্ম ভিতরের দিক থেকে তাকে বাচিয়েছে । আর এও দেখা গেছে, পর্যধর্মে খুব ক্ষুদ্র লোকেও হঠাৎ বড়ো হয়ে উঠেছে, কিন্তু তার নিধন ভিতরের থেকে, যাকে উপনিষদ বলেন, “মহতী বিনষ্টিঃ” । لـ যে-ব্যক্তি ছোটো তারও স্বধর্ম বলে একটি সম্পদ আছে । তার সেই ছোটো কেীটোটির মধ্যেই সেই সন্ধা, ও সম্পদটিকে রক্ষা করে সে পরিত্রাণ পায় । ইতিহাসে তার নাম থাকে না, হয়তো তার বদনাম থাক:৩ও পাবে, কিন্তু তার অন্তর্যামীর খাসদরবারে তার নাম থেকে যায় । লোভে পড়ে। স্বধর্ম বিকিয়ে দিয়ে সে যদি পর্যধর্মের ডঙ্কা বাজাতে যায়। তবে হাটে বাজারে তার নাম হবে । কিন্তু, তার প্রভুর দেববার থেকে তার নাম খোওয়া যাবে । এই ভূমিকার মধ্যে আমার নিজের কৈফিয়ত আছে । কখনো অপরাধ করি নি তা নয় । সেই অপরাধের লোকসান ও পরিতাপ তীব্ৰ বেদনায় অনুভব করেছি। ব’লেই সাবধান হই । ঝড়ের সময় }বতারাকে দেখা যায় না ব'লে দিকভ্ৰম হয় । এক-এক সময়ে বাহিরের কল্লোলে উদভ্ৰান্ত হয়ে স্বধর্মের প্ৰাণা স্পষ্ট করে শোনা যায় না । তখন ‘কর্তব্য’ নামক দশমুখ-উচ্চারিত একটা শব্দের হুঙ্কারে মন আভিভূত হয়ে যায় ; ভুলে যাই যে, কর্তব্য বলে একটা অবচ্ছিন্ন পদার্থ নেই, আমার কর্তবাই হচ্ছে আমার পক্ষে কর্তব্য । গাডির চলাটা হচ্ছে একটা সাধারণ কর্তবা, কিন্তু ঘোরতর প্রয়োজনের সময়েও ঘোড়া যদি বলে “আমি সারথির কর্তব্য করব’, বা চাকা বলে “ ঘোড়ার কর্তব্য করব”, তবে সেই কর্তব্যই ভয়াব’ – হয়ে ওঠে । ডিমক্রেসির যুগে এই উড়ে-পড়া পড়ে-পাওয়া কর্তব্যের ভয়াবহতা চারি দিকে দেখতে পাই ; মানবসংসার চলবে, তার চলাই চাই ; কিন্তু তার চলার রথের নানা অঙ্গকমীরাও একরকম করে তাঙ্গে চালাচ্ছে, গুণীরাও একরকম করে তাকে চালাচ্ছে, উভয়ের স্বানুবর্তিতাতেই পরস্পরের সহায়তা এবং সমগ্র রথের গতিবেগ ; উভয়েব কর্ম একাকার হয়ে গেলেই মোট কর্মটাই পঙ্গু হয়ে যায় । এই উপলক্ষে একটি কথা আমার মনে পড়ছে । তখন লোকমানা টিলক বেঁচে ছিলেন । তিনি তার কোনাে এক দূতের যোগে আমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে বলে পাঠিয়েছিলেন, আমাকে যুরোপে যেতে হবে । সে সময়ে নন-কো-অপারেশন আরম্ভ হয় নি বটে কিন্তু পোলিটিক্যাল আন্দোলনের তুফান বইছে । আমি বললুম, “রাষ্ট্রিক আন্দোলনের কাজে যোগ দিয়ে আমি যুরোপে যেতে পারব না ।” তিনি বলে পাঠালেন, আমি রাষ্ট্রিক চর্চায় থাকি, এ তার অভিপ্ৰায়বিরুদ্ধ । ভারতবর্ষের যে-বাণী ১০|| ২৯