পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী 889 তাই দেখি, শহরের কলেজে-পড়া ছেলে হঠাৎ দেশাত্মবোধের তাড়ায় যখন খামিকা পল্লীর উপকার করতে ছোটে তখন তারা পল্লীবাসীর পাশে এসেও কাছে আসতে পারে না । তারা বেড়ার ভিতর দিয়ে । কথা কয়, পল্লীর কানে বাজে যেন আরবি আওড়াচ্ছে । য়াহােক, যদিও শহুরে সভ্যতার পকে আমাদেরকেও খুব কষে টান দিয়েছে, তবু মনের গ্ৰাম্য অভ্যোস এখনো যায় নি। সময়কে বলতে আরম্ভ করেছি, মূল্যবান, কিন্তু কেউ যদি সে-মূল্য গ্রাহ্য না করে তাকে ঠেকিয়ে রাখবার কোনো ব্যবস্থা আজও তৈরি হয় নি। আমাদের আগন্তুকবর্গ অভিমন্যুর মতো অতি সহজেই ঘরে প্রবেশ করতে জানেন, কিন্তু নিগমনের পথ যে তারা জানেন সে তাদের ব্যবহারে বোঝা যায় না। অত্যন্ত বেগার লোককেও যদি বলা যায়, “কাজ আছে”, সে বলে “ঈস ! লোকটা ভারি অহংকারী” । অর্থাৎ, তোমার কাজটা আমাকে দেখা দেওয়ার চেয়েও মহার্ঘ, এ কথা মনে করা সম্পর্ধা । অসুস্থ শরীরে একদিন আমার তিন-তলার ঘরে অর্ধশয়ান অবস্থায় একটা লেখায় নিযুক্ত আছি। আমি নিতান্তই মৃদুস্বভাবের মানুষ বলেই আমার সেই অন্দরের ঘরটাকেও আমার বন্ধু, অনতিবন্ধু ও অবন্ধুরা দুৰ্গম বলে গণ্য করেন না । এইটুকুমাত্ৰ সুবিধা যে, পথটা পুরবাসীদের সকলেরই জানা নেই। খবর এল, একটি ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছেন । অস্বাস্থ্য বা ব্যস্ততার ওজরকে আমাদের ভদ্রলোকেরা শ্রদ্ধা করেন না, তাই দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে লেখা বন্ধ করে নীচে গেলুম। দেখি, একজন কঁচা বয়সের যুবক ; হঠাৎ তার চাদরের অজ্ঞাতবাস থেকে একটা মোটা-গোছের খাতা বেরল। বুঝলুম, আমারই আপনি সম্প্রদায়ের লোক । কবিকিশোর একটুখানি হেসে আমাকে বললে, “একটা অপেরা লিখেছি।” আমার মুখে বোধ হয় একটা পাংশুবর্ণ ছায়া পড়ে থাকবে, তাই হয়তো আশ্বাস দেবার জন্যে বলে উঠল, “আপনাকে আর কিছুই করতে হবে না, কেবল গানের কথাগুলোতে সুর বসিয়ে দেবেন, সবসুদ্ধ পচিশটা গান ।” কাতর হয়ে বললুম, “সময় কাঁই !” কবি বললে, “আপনার কতটুকুই বা সময় লাগবে । গান-পিছু বড়ো-জোর আধা ঘণ্টাই হােক ৷” সময় সম্বন্ধে এর মনের ঔদার্য দেখে হতাশ হয়ে বললুম, “আমার শরীর অসুস্থ।” অপেরা-রচয়িতা বললে, “আপনার শরীর অসুস্থ, এর উপরে আর কী বলব ! কিন্তু যদি—” । বুঝলুম প্ৰবীণ ডাক্তারের সাটিফিকেট আনলেও নবীন কবি বিচলিত হবে না । কোনো—একজন ইংরেজ গ্রন্থকারের ঘরে এই নাট্যের অবতারণা হলে কোন ফৌজদারিতে তার যবনিকাপাতন হত, সে-কথা মনে করলেও শরীর রোমাঞ্চিত হয় । মানুষের ঘরে “দরওয়াজা বন্ধ” এ কথাটিও কটু, আর তার ঘরে কোথাও পর্দা নেই এটাও বর্বরতা । মধ্যম পন্থাটাই দেখি সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না । দুই বিরুদ্ধ শক্তির সমন্বয়েই সৃষ্টি, তাদের একান্ত বিচ্ছেদই প্ৰলয়, মানুষ নিজের ব্যবহারক্ষেত্রে এইটেই কেবলই ভোলে আর মার খেয়ে মরে । সূর্যের উদয়াস্ত আজও বাদলার ছায়ায় ঢাকা পড়ে রইল । মেঘের থলিটার মধ্যে কৃপণ আকাশ তার সমস্ত সোনার আলো ঐটে বন্ধ করে রেখেছে । SVC Goico ys S8 আজি ক্ষণে ক্ষণে রৌদ্র উকি মারছে, কিন্তু সে যেন তার গারদের গরাদের ভিতর থেকে । তার সংকোচ এখনো ঘুচল না । বাদল-রাজের কালো-উদ-পরা মেঘগুলো দিকে দিকে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে । আচ্ছন্ন সূর্যের আলোয় আমার চৈতন্যের স্রোতস্বিনীতে যেন ভাটা পড়ে গেছে। জোয়ার আসবে রৌদ্রের সঙ্গে সঙ্গে । পশ্চিমে, বিশেষত আমেরিকায় দেখেছি, বাপমায়ের সঙ্গে অধিকাংশ বয়স্ক ছেলেমেয়ের নাড়ীর টান ঘুচে গেছে। আমাদের দেশে শেষ পর্যন্তই সেটা থাকে। তেমনিই দেখেছি, সূর্যের সঙ্গে মানুষের প্রাণের যোগ সে-দেশে তেমন যেন অন্তরঙ্গভাবে অনুভব করে না । সেই বিরলরৌদ্রের দেশে তারা