পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী 8Q ○ অপরাধটা করেছে, আর এই মুক্তি নিয়েই বা করবে। কী । মন বলে, “আমি অশেষের রাজ্যে সন্ধান করতে বেরব, আমি দুঃসাধ্যের সাধনা করব, দুৰ্গমের বাধা কাটিয়ে দিয়ে দুর্লভকে উদ্ধার করে আনব । আমি একটু নড়ে বসতে গেলেই যে-দুঃশাসন নানারকম ভয় দেখিয়ে আমাকে পিছমোড়া করে বাধতে আসে তাকে আমি সম্পূর্ণ হার মানাব। তবে ছাড়ব ।” তাই পুরুষ তপস্বী বলে বসে, “না খেয়েই বা বঁচা । যাবে না কেন । নিশ্বাস বন্ধ করলেই যে মরতে হবে, এমন কী কথা আছে ।” শুধু তাই নয়, এর চেয়েও শক্ত কথা বলে ; বলে, “মেয়েদের মুখ দেখব না । তারা প্ৰকৃতির গুপ্তচর, প্রাণরাজত্বের যত-সব দাস সংগ্ৰহ করবার তারাই আড়কাঠি ।” যে-সব পুরুষ তপস্বী নয় শুনে তারাও বলে, “বাহবা ।” প্রকৃতিস্থ অবস্থায় সাধারণত কোনো মেয়ের দল বলে না, পুরুষকে সম্পূর্ণ বর্জন করাটাই তাদের জীবনের চরম এবং মহােচ্চ লক্ষ্য । সম্প্রতি কোথাও কোথাও কখনো এমন কথার আভাস শোনা যায়, কিন্তু সেটা হল আস্ফালন । প্ৰাণের রাজ্যে মেয়েদের যে চিরকেলে স্থান আছে সেখানকার বন্দরের নোঙর ছিড়ে মনটাকে নিয়ে তারা নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে, এমন কথা দুই-একজন মেয়ে বলতেও পারে ; কারণ, যাত্রারম্ভে ভাগ্যদেবতা যখন জীবনের সম্বল স্ত্রীপুরুষের মধ্যে বঁাটােয়ারা করে দেয়। তখন প্যাক করবার সময় কিছু যে উলটােপালটা হয় না, তা নয় । আসল কথা হচ্ছে, প্রকৃতির ব্যবস্থায় মেয়েরা একটা জায়গা পাকা করে পেয়েছে, পুরুষরা তা পায় নি । পুরুষকে চিরদিন জায়গা খুঁজতে হবে । খুঁজতে খুঁজতে সে কত নতুনেরই সন্ধান পাচ্ছে কিন্তু চরমের আহবান তাকে থামতে দিচ্ছে না, বলছে, “আরো এগিয়ে এসো, ।” একজায়গায় এসে যে পৌচেছে তার একরকমের আয়োজন, আর যাকে চলতে হবে তার আর-একরকমের । এ তো হওয়াই চাই । স্থিতি যে পেয়েছে বসে বসে ক্রমে ক্ৰমে চারি দিকের সঙ্গে আপন সম্বন্ধকে সে সত্য করতে, পূর্ণ করতে চেষ্টা করে। কেননা, সম্বন্ধ সত্য হলে তবেই তার মধ্যে মুক্তি পাওয়া যায় । যার সঙ্গে ঘর করতে হচ্ছে তার সঙ্গে যদি কেবলই খিটিমিটি বাধতে থাকে তা হলে তার মতো জীবনের বাধা আর কিছু নেই। যদি ভালোবাসা হয় তা হলেই তার সঙ্গে সম্বন্ধের মধ্যে মুক্তি ঘটে । সে মুক্তি বাইরের সমস্ত দুঃখ-অভাবের উপর জয়ী হয় । এইজন্যেই মেয়ের জীবনে সকলের চেয়ে বড়ো সার্থকতা হচ্ছে প্ৰেমে । এই প্রেমে সে স্থিতির বন্ধনিরাপ ঘুচিয়ে দেয় ; বাইরের অবস্থার সমস্ত শাসনকে ছাড়িয়ে যেতে পারে । মুক্তি না হলে কর্ম হতে পারে। কিন্তু সৃষ্টি হতে পারে না । মানুষের মধ্যে সকলের চেয়ে চরমশক্তি হচ্ছে সৃষ্টিশক্তি । মানুষের সত্যকার আশ্রয় হচ্ছে আপনার সৃষ্টির মধ্যে ; তার থেকে দৈন্যবশত যে বঞ্চিত সে “পরাবসথশায়ী” । মেয়েকেও সৃষ্টি করতে হবে, তবে সে আপনার বাসা পাবে। তার পক্ষে এই সৃষ্টি প্রেমের দ্বারাই সম্ভব । যে-পুরুষসন্ন্যাসী নিজের কৃচ্ছসাধনের প্রবল দম্ভে মনে করে যে, যেহেতু মেয়েরা সংসারে থাকে। এই জন্যে তাদের মুক্তি নেই, সে সত্যকে জানে না । যে মেয়ের মধ্যে সত্য আছে সে আপনি বন্ধনকে স্বীকার করেই প্রেমের দ্বারা তাকে অতিক্রম করে ; বন্ধনকে ত্যাগ করার চেয়ে এই মুক্তি বড়ো । সব মেয়েই যে তার জীবনের সার্থকতা পায় তা নয় ; সব পুরুষই কি পায় । অনুরাগের সত্যশক্তি সব মেয়ের নেই, বৈরাগ্যের সত্যশক্তি সব পুরুষে মেলে না। কিন্তু, অন্তত আমাদের দেশে দেখা যায়, পুরুষ সাধক সংসারকে বন্ধনশালা বলেই জানে ; তার থেকে উর্ধ্বশ্বাসে বহুদূরে পালিয়ে যাওয়াকেই মুক্তির উপায় মনে করে । তার মানে, আমরা যাকে সংসার বলি স্বভাবত সেটা পুরুষের সৃষ্টিক্ষেত্র নয়। এইজন্যে সেখানে পুরুষের মন ছাড়া পায় না। মেয়েরা যখনই মাতৃত্বের অধিকার পেয়েছে তখনই এমন-সকল হৃদয়বৃত্তি পেয়েছে যাতে করে সংসারের সঙ্গে সম্বন্ধস্থাপন তাদের পক্ষে সহজ হতে পারে । এইজন্যে যো-মেয়ের মধ্যে সেই হৃদয়বৃত্তির উৎকর্ষ আছে সে আপনার ঘরসংসারকে সৃষ্টি করে তোলে। এ সৃষ্টি তেমনই যেমন সৃষ্টি কাব্য, যেমন সৃষ্টি সংগীত, যেমন সৃষ্টি রাজ্যসাম্রাজ্য । এতে কত সুবুদ্ধি, কত নৈপুণ্য, কত ত্যাগ, কত আত্মসংযম পরিপূর্ণভাবে সম্মিলিত হয়ে অপরাপ সুসংগতি লাভ করেছে। বিচিত্রের এই সম্মিলন একটি অখণ্ডরাপের ঐক্য পেয়েছে ; তাকেই বলে সৃষ্টি । এই কারণেই ঘরকন্নায় মেয়েদের এত একান্ত