পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী 8G G আঁকড়ি দিয়ে জড়িয়ে ধরবার দীর্ঘ সময় তার কখনো ছিল না। এই জন্যে সৃষ্টির প্রয়োজনে প্ৰলয় করতে তার দ্বিধা নেই । মোট কথা বাস্তবের মধ্যে যে-সব বিশেষের বাহুল্য আছে তাকে বাদ দিয়ে পুরুষ একের সম্পূর্ণতা খোজে। এইজন্যেই অধ্যাত্মরাজ্যে পুরুষেরই তপস্যা ; এইজন্যে সন্ন্যাসের সাধনায় এত পুরুষের এত আগ্রহ। এবং এইজন্যেই ভাব রাজ্যে পুরুষের সৃষ্টি এত বেশি উৎকর্ষ এবং জ্ঞানরাজ্যে এত বেশি সম্পদ লাভ করেছে । - পুরুষের এই সমগ্রতার পিপাসা তার প্ৰেমেও প্রকাশ পায় । সে যখন কোনো মেয়েকে ভালোবাসে তখন তাকে একটি সম্পূর্ণ অখণ্ডতায় দেখতে চায় আপনার চিত্তের দৃষ্টি দিয়ে, ভাবের দৃষ্টি দিয়ে। পুরুষের কাব্যে বার বার তার পরিচয় পাওয়া যায় । শেলীর এপিসিকীডিয়ন পড়ে দেখো । মেয়েরা এ কথা জানে । পুরুষের এই প্রার্থনা মেয়েদের বিশেষ করে সৃষ্টি করতে থাকে । কেননা, প্রার্থনার বেগ, প্রার্থনার তাপ, মানুষের সংসারে সৃষ্টির একটা প্ৰধান শক্তি । আমরা কী চাইব সেটা যদি ঠিকমত ধরতে পারি তা হলে আমরা কী পাব সেটা নিয়ে ভাবতে হয় না । পুরুষেরা একরকম ক’রে চেয়ে চেয়ে মেয়েদের একরকম করে গড়ে তুলেছে । মেয়েরা আপনার জীবনে এত জায়গায় এত পর্দা খাটায়। এই জন্যে ; আপনার থেকে সে কত কী বাদ দিয়ে চলে । আমরা বলি লজ্জা স্ত্রীলোকের ভূষণ । তার মানে, লজ্জা হচ্ছে সেই বৃত্তি যাতে করে মেয়েরা আপনার বাস্তবের বাহুল্যকে সরিয়ে রাখে ; মেয়ের রাজ্যে এই জন্যে মস্ত একটা অগোচরতার ব্যবস্থা আছে । সে আপনার এতখানি বাকি রেখেছে যা পুরুষ আপনার মন দিয়ে পুরিয়ে নিতে পারে । সে আপনার খাওয়া-শোওয়া, চাল-চলন, বাসনা-সাধনা, । সমস্ত থেকেই অতিবাস্তবের প্রত্যক্ষতা এতটা পরিমাণে ঢাকা দেয় যাতে পুরুষের ভাবের মধ্যে, তার ছবি সম্পূর্ণ হয়ে উঠতে বাধা না পায় । মেয়েদের সঙ্গে পুরুষের ব্যবহারে সম্পূর্ণ এর উলটাে দিকটাও দেখা যায় । পুরুষ কখনো কখনো এমন কাণ্ড করে যেন নারীর মধ্যে অনির্বচনীয়তার কোনো আভাস নেই, যেন তার মাটির প্রদীপে কোনো আলোই জ্বলে নি ; তখন লুব্ধ দাত দিয়ে তাকে সে আখের মতো চিবিয়ে আবর্জনার মধ্যে ফেলে দেয় । সাত্ত্বিকের ঠিক উলটােপিঠেই থাকে তামসিক ; পূর্ণিমারই অন্য পারে অমাবস্যা। রাস্তার এ দিকটাতে যে সত্য থাকে ঠিক তার সামনের দিকেই তার বিপরীতের বাসা । ফেউ সাক্ষ্য দেয় বাঘেরই অস্তিত্বের । সেই একই কারণে মেয়ে সংসারস্থিতির লক্ষ্মী, আবার সংসার ছারখার করবার প্ৰলংয়াকরীও তার মতো কেউ নেই । r - যা হােক, এটা দেখা যাচ্ছে, সর্বত্রই সর্বকালেই মেয়ে নিজের চার দিকেই একটা বিচিত্ৰ চিত্ৰখচিত বেড়ার দূরত্ব তৈরি করে রেখেছে। দুৰ্গমকে পার হবার জন্যে পুরুষের যে স্বাভাবিক অধ্যবসায় আছে সেইটােকে যতটা পারে সে জাগরকে করে রাখে। পড়ে-পাওয়া জিনিস মূল্যবান হলেও তাতে পুরুষের তৃপ্তি নেই ; যাকে সে জয় করে পায় তাকেই সে যথার্থ পায় বলে জানে ; কেননা, জয় করে পাওয়া হচ্ছে মন দিয়ে পাওয়া । এইজন্যে অনেক ছল-যুদ্ধের আয়োজনে মেয়েদের সময় কাটে । নীতিনিপুণ বলে বসবে, এই মায়া তো ভালো নয় । পুরুষ নিজেই চিরকাল ধরে দাবি করলে এই মায়াকে ; এই মায়াসৃষ্টির বড়ো বড়ো উপকরণ সে জুগিয়ে দিলে নিজের কল্পরিাজ্য থেকে ; কবিরা চিত্রীরা মিলে নারীর চার দিকে রঙবেরঙের মায়ামণ্ডল আপনি ইচ্ছায় বানিয়ে দিলে- অবশেষে এই মায়ার কাছে পরাভবশঙ্কায় ত্ৰস্ত সাধুসজ্জন মেয়েজাতকে মায়াবিনী বলে গাল দিতে লেগেছে ; তার মায়াদুর্গের উপরে বহুকাল থেকে তারা নীরস শ্লোকের শতয়ী বর্ষণ করছে, কোথাও দাগ পড়ছে না । ফেলেছে- এ-সমস্তর ভিতর থেকে একেবারে খাটি সত্য-মেয়েটিকে উদ্ধার করা চাই । তাদের মতে, সাহিত্যে শিল্পে সব জায়গাতেই এই অবাস্তব মেয়ের ভূতের উপদ্ৰব অত্যন্ত বেশি। এরা মনে করে, মায়া থেকে ছাড়িয়ে নিলেই বাস্তব সত্যকে পাওয়া যাবে। 'ኳ