পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী 8ó “ላ পূর্বেই বলেছি, মেয়ের প্ৰেম পুরুষের সমস্ত খুঁটিনাটি দোষত্রুটি সমেত বিশেষত্বকে প্রত্যক্ষ করে পেতে চায় । সঙ্গ তার নিতান্তই চাই । পুরুষও আপনাকে লুকিয়ে রাখে নি, ঢেকে রাখে নি ; সে অত্যন্ত অসজিত এলোমেলো আটপৌরে ভাবেই মেয়ের ভালোবাসার কাছে আগাগোড়া নিজেকে ফেলে রেখে দিয়েছে ; এতেই মেয়ে যথার্থ সঙ্গ পায়, আনন্দ পায় । - কিন্তু, পুরুষের পক্ষে মেয়ে আপনার সঙ্গে সঙ্গেই একটা দূরত্ব নিয়ে আসে ; তার মধ্যে খানিকটা পরিমাণে নিষেধ আছে, ঢাকা আছে। ফোটােগ্রাফের মধ্যে সব আছে, কিন্তু আটিস্টের ছবির মধ্যে সব নেই ; এই জন্যে তাতে যে ফাঁকা থাকে। সেইখানে রসজ্ঞের মন কাজ করতে পারে । সেইরকমের ফাকাটুকু মেয়েদের একটা সম্পদ, সেটা সম্পূর্ণ লুপ্ত করতে নেই। বিয়াত্রিচে দান্তের কল্পনাকে যেখানে তরঙ্গিত করে তুলেছে সেখানে বস্তুত একটি অসীম বিরহ। দাস্তের হৃদয় আপনার পূর্ণচন্দ্রকে পেয়েছিল বিচ্ছেদের দূর আকাশে । চণ্ডীদাসের সঙ্গে রজকিনী রামীর হয়তো বাইরের বিচ্ছেদ ছিল না, কিন্তু কবি যেখানে তাকে ডেকে বলছে, তুমি সে নয়নের তারাসেখানে রজকিনী রামী কোন দূরে চলে গেছে তার ঠিক নেই। হােক-না সে নয়নের তারা, তবুও যে নারী বেদবাদিনী, হরের ঘরানী, সে আছে বিরহলোকে । সেখানে তার সঙ্গ নেই, ভাব আছে। নারীর প্রেমে মিলনের গান বাজে, পুরুষের প্রেমে বিচ্ছেদের বেদনা। SRT VENGIKK ya 8 আমি বলছিলুম, মেয়েরা পর্দােনশিন । যে কৃত্রিম পর্দা দিয়ে কৃপণ পুরুষ তাদের অদৃশ্য করে লুকিয়ে রাখে আমি সেই বর্বর পর্দাটার কথা বলছি নে ; নিজেকে সুসমাপ্তভাবে প্ৰকাশ করবার জন্যেই তারা যে-সব আবরণকে সহজপটুত্বে আভরণ করে তুলেছে আমি তার কথাই বলছি । এই যে নিজের দেহকে, গৃহকে, আচরণকে, মনকে নানা বর্ণ দিয়ে, ভঙ্গি দিয়ে, সংযম দিয়ে, অনুষ্ঠান দিয়ে, নিজের বিচিত্র একটি বেষ্টনকে তারা সুসজ্জিত করতে পেরেছে, এর কারণ, তারা স্থিতির অবকাশ পেয়েছে। স্থিতির মূল্যই হচ্ছে তার আবরণের ঐশ্বৰ্যে, তার চারি দিকের দাক্ষিণ্যে, তার আভাসে, ব্যঞ্জনায়, তার হাতে যে সময় আছে সেই সময়টার মনোহর বৈচিত্র্যে । সবুরে মেওয়া ফলে, কেননা, মেওয়া যে প্রাণের জিনিস, কলের ফরমাশে তাকে তাড়াহুড়ো করে গড়ে তোলা যায় না । সেই বহুমূল্য সবুরটা হচ্ছে স্থিতির ঘরের জিনিস। এই সবুরটাকে যদি সরস এবং সফল করতে না পারা গেল। তবে তার মতো আপদ আর নেই। মরুভূমি অনাবৃত, তার অবকাশের অভাব নেই। অথচ সেই অবকাশ রিক্ত ; এই কঠিন নগ্নতা পীড়া দেয় । কিন্তু, যেখানে পোড়ো জমি পোড়ো হয়ে নেই। সেখানে সে ফসলে ঢাকা, ফুলে বিচিত্র ; সেখানে তার সবুজ ওড়না বাতাসে দুলে উঠছে। যে পথিক পথে চলে সেখানেই সে পায় তারা তৃষ্ণার। জল, ক্ষুধার অন্ন, তার আরামের ছায়া, ক্লাস্তির শুশ্রুষা । সেখানকার স্থিতির পূর্ণতাই তার গতির সহায় ; অবারিত মরুভূমি সবচেয়ে বাধা । নারী স্বভাবতই যে স্থিতি পেয়েছে বসে বসে ধীরে ধীরে সে স্থিতিকে রাঙিয়ে তুলে আপনি হৃদয়রাসে রসিয়ে নিয়ে তাই দিয়ে আপন বুকের কঁাচলি আপন মুখের ঘোমটা বানিয়েছে। এই ঢাকাতেই সে আপনার ঐশ্বৰ্য প্ৰকাশ করেছে পুস্পপল্লবের আবরণেই যেমন লতার ঐশ্বৰ্য । কিন্তু হঠাৎ আজকাল পাশ্চাত্যসমাজে শুনতে পাচ্ছি, নারী বলছে, “আমি মায়ার আবরণ রাখব না, পুরুষের সঙ্গে ব্যবধান ঘুচিয়ে দেব । আমি হব বিজ্ঞানের চাঁদ ; তার চারি দিকে বায়ুমণ্ডল নেই, মেঘ নেই, রঙ নেই, কোমল শ্যামলের চঞ্চল বিচিত্ৰতা নেই, তার কালো কালো ক্ষতিগুলোর উপরে পর্দা নেই, আমিও হব তেমনি । এতদিন যাকে বলে এসেছি লজা, যাকে বলে এসেছি শ্ৰী, আজ তাতে