পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 upbr রবীন্দ্র-রচনাবলী আপনার সহজ আয়োজনের অনুপাতে নিজের ভোগকে সংযত করেছিল । তখন তারা বুঝেছিল, মানুষের আসল প্রয়োজনের ভার খুব বেশি নয় । যুদ্ধ-অবসানে সে কথাটা ভুলতে দেরি হয় নি । অনতিপ্রয়োজনীয়কে প্রয়োজনীয় করে তোলা যখন দেশসুদ্ধ সকল লোকেরই নিত্য সাধনা হয়। তখন বিশ্বব্যাপী দাসুবৃত্তি অপরিহার্য হয়ে ওঠে । লোকসংখ্যাবৃদ্ধির সমস্যা নিয়ে পাশ্চাত্যেরা অনেকেই উদবেগ প্ৰকাশ করে থাকেন । সমস্যাটি কঠিন হবার প্রধান কারণ হচ্ছে, সর্বসাধারণেরই ভোগবাহুল্যের প্রতি দাবি । এত বড়ো ব্যাপক দাবি মেটাতে গেলে ধর্মরক্ষা করা চলে না, মানুষকে মানুষপীড়ক হতেই হয় । সেই পীড়নকার্যে ভালো করে হাত পাকানো হয় দূরস্থ অনাত্মীয় জাতির উপর দিয়ে । এর বিপদ এই যে, জীবনক্ষেত্রের যে কিনারাতেই ধর্মবুদ্ধিতে আগুন লাগানো হােক-না, সে আগুন সেইখানেই থেমে থাকে না । ভোগী স্বভাবতই যে নিষ্ঠুরতার সাধনা করে তার সীমা নেই, কারণ, আত্মম্ভরিতা কোথাও এসে বলতে জানে না, “এইবার বস হয়েছে।” বস্তুগত আয়োজনের অসংগত বাহুল্যকেই যে সভ্যতার প্রধান লক্ষণ বলে মানা হয় সে সভ্যতা অগত্যাই নরভুক । নররক্তশোষণের বিশ্বব্যাপী চর্চা একদিন আত্মহত্যায় ঠেকবেই, এতে আর সন্দেহ করা চলে না । রেলগাড়ির ভোজনশালায় এক দিকে যেমন দেখা গেল ভোগের বাহুল্য, আর-এক দিকে তেমনি দেখলেম কর্মের গতিবেগ । সময় অল্প, আরোহী অনেক, ভোজ্যের বৈচিত্ৰ্য প্রচুর, ভোজের উপকরণ বিস্তর- তাই পরিবেশনকর্মের অভ্যাস অতি আশ্চর্য দ্রুত হয়ে উঠেছে। পরিবেশনের যন্ত্রটাতে খুবই প্রবল জোরে দম দেওয়া হয়েছে । যেটা, এই পরিবেশনে দেখা গেল পাশ্চাত্যের সমস্ত কর্মচালনার মধ্যেই সেই ক্ষিপ্ৰবেগ । যে যন্ত্র বাহিরের ব্যবহারের জন্য তার গতির ছন্দ দম দিয়ে অনেকদূর পর্যন্ত বাড়িয়ে তোলা চলে । কিন্তু আমাদের প্রাণের, আমাদের হৃদয়ের ছন্দের একটা স্বাভাবিক লয় আছে ; তার উপরে দ্রুত প্রয়োজনের জবরদস্তি থাটে না । দ্রুত-চলাই যে দ্রুত-এগোনো সে কথা সত্য হতে পারে কলের গাড়ির পক্ষে, মানুষের পক্ষে না । মানুষের চলার সঙ্গে হওয়া আছে ; সেই চলাতে হওয়াতে মিল ক’রে চলাই মানুষের চলা, কলের গাড়ির সে উপসর্গ নেই। আপিসের তাগিদে মুহুর্তের মধ্যে এক গ্রাসের জায়গায় চার গ্রাস-খাওয়া অসম্ভব নয় । কিন্তু, সেই চার গ্রাস ঘড়ি ধরে হজম করা কলের মনিবের হুকুমে হতে পারে না । গ্রামোফোনের কান যদি মলে দেওয়া যায়। তবে যে গান গাইতে চার মিনিট লেগেছিল তাকে শুনতে আধ মিনিটের বেশি না লাগতে পারে, কিন্তু সংগীত হয়ে ওঠে চীৎকার । রসভোগ করবার জন্যে রসনার নিজের একটা নির্ধারিত সময় আছে ; সন্দেশকে যদি কুইনিনের বড়ির মতো টপ করে গেলা যায় তা হলে বস্তুটাকে পাওয়া যায়, বস্তুর রস পাওয়া যায় না ; তীরবেগে বাইসিকল ছুটিয়ে যদি পদাতিক বন্ধুর চাদর ধরি তা হলে বাইসিকলের জয়পতাকা হাতে আসবে, কিন্তু বন্ধুকে বুকে পাবার উপায় সেটা নয় ; কলের বেগ বাইরের দরকারে কাজে লাগে, অস্তরের দাবি মেটাবার বেলায় অন্তরের ছন্দ না মানলে চলে না । বাইরের বেগ অস্তরের ছন্দকে অত্যন্ত বেশি পেরোয় কখন । যখন বাহ্য প্রয়োজনের বড়ো বাড় বাড়ে । তখন মানুষ পড়ে পিছিয়ে, কলের সঙ্গে সে তাল রাখতে পারে না । য়ুরোপে সেই মানুষ-ব্যক্তিটি দিনে দিনে বহু দূরে পড়ে গেল ; কল গেল এগিয়ে ; তাকেই সেখানকার লোকে বলে অগ্রসরতা, প্রোগ্রেস । সিদ্ধি, যাকে ইংরেজিতে বলে সাকসেস, তার বাহন যত দৌড়ে চলে ততই ফল পায়। য়ুরোপের দেশে দেশে রাষ্ট্রনীতির যুদ্ধনীতির বাণিজ্যনীতির তুমুল ঘোড়দৌড় চলছে। জলে স্থলে আকাশে । সেখানে বাহ্য প্রয়োজনের গরজ অত্যন্ত বেশি হয়ে উঠল, তাই মনুষ্যত্বের ডাক শুনে কেউ সবুর করতে পারছে না । বীভৎস সৰ্ব্বভুক পেটুকতার উদ্যোগে পলিটিকস নিয়ত ব্যস্ত। তার গাট-কাটা ব্যবসায়ের পরিধি পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছে। পূর্বকালে যুদ্ধবিগ্রহের পদ্ধতিতে ধর্মবুদ্ধি যেখানে মাঝে মাঝে বাধা খাড়া করে রেখেছিল, ডিপ্লমাসি সেখানে আজ লাফ-মারা হার্ডল রেস খেলে চলেছে। সবুর সয় না যে ! বিষবায়ুবাণ যুদ্ধের অস্ত্ররূপে যখন এক পক্ষ ব্যবহার করলে তখন অন্য পক্ষ ধর্মবুদ্ধির