পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

i 8 AK) অজানা সামগ্ৰী ভেসে ভেসে ঘাটে এসে লাগে । মনে হয় না, তাতে আমার বাধা বরাদের জোর আছে। সেই আচমকা পাওয়ার বিস্ময়ই তাকে উজ্জ্বল করে তোলে, উল্কা যেমন হঠাৎ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে এসে আগুন হয়ে ওঠে । পৃথিবীতে আমার প্ৰেয়সীদের মধ্যে যিনি সর্বকনিষ্ঠ তার বয়স তিন । ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলে যেতে তার এক মুহুর্ত বিরাম নেই। শ্রোতা। যারা তারা উপলক্ষ ; বস্তুত কথাগুলো নিজেকেই নিজে শোনানো ; যেমন বাষ্পরাশি ঘুরতে ঘুরতে গ্ৰহতারারূপে দানা বেঁধে ওঠে তেমনি কথা-বলার বেগে আপনিই তার সজাগ মনে চিন্তার সৃষ্টি হতে থাকে । বাইরে থেকে মাস্টারের বাচালতা যদি এই স্রোতকে ঠেকায় তা হলে তার আপনি চিন্তাধারার সহজ পথ বন্ধ হয়ে যায় । শিশুর পক্ষে অতিমাত্রায় পুঁথিগত বিদ্যাটা ভাবনার স্বাভাবিক গতিকে আটকিয়ে দেওয়া । বিশ্বপ্রকৃতি দিনরাত্ৰি কথা কইছে, সেই কথা যখন শিশুর মনকে কথা কওয়ায় - তখন তার সেই আপনি কথাই তার সব চেয়ে ভালো শিক্ষাপ্রণালী । মাস্টার নিজে কথা বলে, আর ছেলেকে বলে “চুপ” । শিশুর চুপ-করা মনের উপর বাইরের কথা বোঝার মতো এসে পড়ে, খাদ্যের মতো নয় । যে-শিশুশিক্ষাবিভাগে মাস্টারের গলাই । শোনা যায়, শিশুরা থাকে। নীরব, সেখানে আমি বুঝি মরুভূমির উপর শিলাবৃষ্টি হচ্ছে। যাই হােক, মাস্টারের হাতে বেশি দিন ছিলেম না বলে আমি যা-কিছু শিখেছি সে কেবল বলতে-বলতে । বাইরে থেকেও কথা শুনেছি, বই পড়েছি ; সে কোনোদিনই সঞ্চয় করবার মতো শোনা নয়, মুখস্থ করবার মতো পড়া নয় । কিছু-একটা বিশেষ করে শেখবার জন্যে আমার মনের ধারার মধ্যে কোথাও বাধ বাধি নি । তাই সেই ধারার মধ্যে যা এসে পড়ে তা কেবলই চলাচল করে, ঠাই বদল করতে করতে বিচিত্র আকারে তারা মেলে মেশে। এই মনোধারার মধ্যে রচনার ঘূর্ণি যখন জাগে তখন কোথা হতে কোন সব ভাসা কথা কোন প্রসঙ্গমূর্তি ধরে এসে পড়ে তা কি আমি জানি ? অনেকে হয়তো ভাবেন, ইচ্ছা করলেই বিশেষ বিষয় অবলম্বন করে আমি বিশেষভাবে বলতে বা লিখতে পারি | র্যারা পাকা বক্তা বা পাকা লেখক তারা পারেন ; আমি পারি। নে । যার আছে গোয়াল, ফরমাশ করলেই বিশেষ বাধা গোরুটাকে বেছে এনে সে দুইতে পারে । আর যার আছে অরণ্য, যে-গোরুটা যখন এসে পড়ে তাকে নিয়েই তার উপস্থিতমত কারবার । আশু মুখুজে মশায় বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করতে হবে । তখন তো ভয়ে ভয়ে বললেম, আচ্ছা । তার পরে যখন জিজ্ঞাসা করলেন বিষয়টা কী, তখন চোখ বুজে বলে দিলেম, সাহিত্য সম্বন্ধে । সাহিত্য সম্বন্ধে কী যে বলব। আগেভাগে তা জানিবার শক্তিই ছিল না । একটা অন্ধ ভরসা ছিল যে, বলতে বলতেই বিষয় গড়ে উঠবে । তিনদিন ধরে বকেছিলেম । শুনেছি। অনেক অধ্যাপকের পছন্দ হল না । বিষয় এবং তখন মনের মধ্যে বিষয় বলে কোনো বালাই ছিল না । বিষয় নিয়েই র্যাদের প্রতিদিনের কারবার বিষয়হীনের অকিঞ্চনত তাদের কাছে ফস করে ধরা পড়ে গেল । এবার ইটালিতে মিলান শহরে আমাকে বক্তৃতা দিতে হয়েছিল। অধ্যাপক ফমিকি বারবার করলেন, বিষয়টা কী ? কী করে তাকে বলি যে, যে-অন্তর্যামী তা জানেন তাকে প্রশ্ন করলে জবাব দেন না । তার ইচ্ছা ছিল, যদি একটা চুম্বক পাওয়া যায়। তবে আগেই সেটা তৰ্জমা করে ছাপিয়ে রাখবেন । আমি বলি, সর্বনাশ ! বিষয় যখন দেখা দেবে চুম্বক তার পরেই সম্ভব । ফল ধরবার আগেই তার আঁঠি খুঁজে পাইকী উপায়ে । বক্তৃতা সম্বন্ধে আমার ভদ্র অভ্যাস নেই, আমার অভ্যাস লক্ষ্মীছাড়া । ভেবে বলতে পারি নে, বলতে বলতে ভাবি, মৌমাছির পাখা যেমন উড়তে গিয়ে গুনগুন করে । সুতরাং, অধ্যাপক হবার আশা আমার নেই, এমন-কি, ছাত্র হবারও ক্ষমতার অভাব । এমনি করে দৈবক্রমে বৈরাগীর তত্ত্বকথাটা বুঝে নিয়েছি। যারা বিষয়ী তারা বিশ্বকে বাদ দিয়ে বিশেষকে খোজে । যারা বৈরাগী তারা পথে চলতে চলতেই বিশ্বের সঙ্গে মিলিয়ে বিশেষকে চিনে নেয়। উপরি-পাওনা ছাড়া তাদের কোনো বাধাপাওনাই নেই। বিশ্বপ্ৰকৃতি স্বয়ং যে এই লক্ষ্যহীন বৈরাগী- চলতে চলতেই তার যা-কিছু পাওয়া । জড়ের রাস্তায় চলতে চলতে সে হঠাৎ পেয়েছে