পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88 রবীন্দ্র-রচনাবলী প্ৰাণকে, প্ৰাণের রাস্তায় চলতে চলতে সে হঠাৎ পেয়েছে মানুষকে । চলা বন্ধ করে যদি সে জমাতে থাকে তা হলেই সৃষ্টি হয়ে ওঠে। জঞ্জাল। তখনই প্রলয়ের ঝাটার তলব পড়ে। বিশ্বের মধ্যে একটা দিক আছে যেটা তার স্থাবর বস্তুর অর্থাৎ বিষয়সম্পত্তির দিক নয় ; যেটা তার চলচ্চিত্তের নিত্য প্রকাশের দিক । যেখানে আলো ছায়া সুর, যেখানে নৃত্য গীত বৰ্ণ গন্ধ, যেখানে আভাস ইঙ্গিত । যেখানে বিশ্ববাউলের একতারার কংকার পথের বঁাকে বাকে বেজে বেজে ওঠে, যেখানে সেই বৈরাগীর উত্তরায়ের গেরুয়া রঙ বাতাসে বাতাসে ঢেউ খেলিয়ে উড়ে যায়। মানুষের ভিতরকার বৈরাগীও আপনি কাব্যে গানে ছবিতে তারই জবাব দিতে দিতে পথে চলে, তেমনিতরোই গানের নাচের রূপের রসের ভঙ্গীতে। বিষয়ী লোক আপন খাতাঞ্চিখানায় বসে যখন তা শোনে তখন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, “বিষয়টা কী। এতে মুনাফা কী আছে। এতে কী প্রমাণ করে।” অধরকে ধরার জায়গা সে খোজে তার মুখবাধা থলিতে, তার চামড়াবাধানো খাতায় । নিজের মনটা যখন বৈরাগী হয় নি। তখন বিশ্ববৈরাগীর বাণী কোনো কাজে লাগে না । তাই দেখেছি, খোলা রাস্তার বঁাশিতে হঠাৎ-হাওয়ায় যে গান বনের মর্মরে নদীর কল্লোলের সঙ্গে সঙ্গে বেজেছে, যে-গান ভোরের শুকতারার পিছে পিছে অরুণ-আলোর পথ দিয়ে চলে গেল, শহরের দরবারের ঝাড়লন্ঠনের আলোতে তারা ঠাই পেল না ; ওস্তাদের বললে “এ কিছুই না”, প্রবীণেরা বললে, “এর মানে নেই” ! কিছু নয়ই তো বটে ; কোনাে মানে নেই, সে-কথা খাটি ; সোনার মতো নিকষে কষা যায় না, পাটের বস্তার মতো দাড়িপাল্লায় ওজন চলে না । কিন্তু, বৈরাগী জানে, অধর রসেই ওর রস । কতবার ভাবি গান তো এসেছে গলায় কিন্তু শোনাবার লগ্ন রচনা করতে তো পারি। নে ; কান যদি-বা খোলা থাকে আনমনার মন পাওয়া যাবে কোথায় । সে-মন যদি তার গদি ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে পারে। তবেই-তো যা বলা যায় না। তাই সে শুনবে, যা জানা যায় না। তাই সে বুঝবে । ১২ই ফেব্রুয়ারি ১৯২৫ জন্মকাল থেকে আমাকে একখানা নির্জন নিঃসঙ্গতার ভেলার মধ্যে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তীরে দেখতে পাচ্ছি। লোকালয়ের আলো, জনতার কোলাহল ; ক্ষণে ক্ষণে ঘাটেও নামতে হয়েছে, কিন্তু কোনোখানে জমিয়ে বসতে পারি নি। বন্ধুরা ভাবে তাদের এড়িয়ে গেলুম ; শত্রুরা ভাবে, অহংকারেই দূরে দূরে থাকি। যে-ভাগ্যদেবতা বরাবর আমাকে সরিয়ে সরিয়ে নিয়ে গেল, পাল গোটাতে সময় দিলে না, রাশি যতবার ডাঙার খোটায় বেঁধেছি টান মেরে ছিড়ে দিয়েছে, সে কোনো কৈফিয়ত দিলে না । সুখদুঃখের হিসাবনিকাশ নিয়ে ভাগ্যের সঙ্গে তকরার করে লাভ নেই। যা হয়েছে তার একটা হেতু আছে, সেই হেতুর উপর রাগ করলে হাওয়ার উপরেই রাগতে হয়। ঘড়া রাগ করে ঠং ঠং শব্দে যদি বলে “আমাকে শূন্য করে গড়েছে কেন”, তার জবাব হচ্ছে, “তোমাকে শূন্য করবে বলেই ঘড়া করে নি, ঘড়া করবে বলেই শূন্য করেছে।” ঘড়ার শূন্যতা পূর্ণতারই অপেক্ষায় ; আমার এফলা-আকাশের ফাকটাকে ভরতি করতে হবে, সেই প্রত্যাশাটা আমার সঙ্গে সঙ্গে লেগে আছে। দৈবের এই দাবিটিই আমার সম্মান ; একে রক্ষা করতে হলে পুরাপুরি দাম দিতে হবে। তাই শূন্য আকাশে একলা বসে ভাগ্যনির্দিষ্ট কাজ করে থাকি। তাতেই আমার হওয়ার অর্থটা বুঝি, কাজেই আনন্দও পাই। বাঁশির ফাকটা যখন সুরে ভরে ওঠে তখন তার আর-কোনো নালিশ থাকে শরীরে মনে প্ৰাণের দক্ষিণ হাওয়া যখন জোরে বয় তখন আত্মপ্ৰকাশের দক্ষিণ্যেই আমার যথেষ্ট পুরস্কার মেলে। কিন্তু যখন ক্লান্তি আসে, যখন পথ ও পাথেয় দুই-ই যায় কমে অথচ সামনে পথটা দেখতে পাই সুদীর্ঘ, তখন ছেলেবেলা থেকে যে-ঘর বঁাধবার সময় পাই নি সেই ঘরের কথা মন