পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

यी 8 ዒ (፩ জিজ্ঞাসা করতে থাকে । তখনই আকাশের তারা ছেড়ে দীপের আলোর দিকে চোখ পড়ে । জীবলোকে ছোটো ছোটো মাধুরীর দৃশ্য যা তীরের থেকে দেখা দিয়ে সরে সরে গিয়েছে, চোখের উপরকার আলো স্নান হয়ে এলে সেই অন্ধকারে তাদের ছবি ফুটে ওঠে ; তখন বুঝতে পারি, সেই সব ক্ষণিকের দেখা প্ৰত্যেকেই মনের মধ্যে কিছু-না-কিছু ডাক দিয়ে গেছে। তখন মনে হয়, বড়ো বড়ো কীর্তি গড়ে তোলাই-যে বড়ো কথা তা নয়, পৃথিবীতে যো-প্ৰাণের যজ্ঞ সম্পন্ন করবার জন্যে নিমন্ত্রণ পেয়েছি তাতে উৎসবের ছোটাে পেয়ালাগুলি রসে ভরে তোলা শুনতে সহজ, আসলে দুঃসাধ্য । এবারে ক্লান্ত দুর্বল শরীর নিয়ে বেরিয়েছিলুম। তাই, অন্তরে যে-নারীপ্ৰকৃতি অন্তঃপুরচারিণী হয়ে বাস করে ক্ষণে ক্ষণে সে আপনি ঘরের দাবি জানাবার সময় পেয়েছিল । এই দাবির মধ্যে আমার পক্ষে কেবল যে আরামের লোভ তা নয়, সার্থকতার আশাও রয়েছে । জীবনপথের শেষদিকে বিশ্বলক্ষ্মীর আতিথ্যের জন্যে শ্ৰান্ত চিত্তের যে ঔৎসুক্য সে কেবল শক্তির অপচয় নিবারণের আগ্রহে, পাথেয় পূর্ণ করে নেবার জন্যে । কাজের হুকুম এখনো মাথার উপর অথচ উদ্যম এখন নিস্তেজ, মন তাই প্রাণশক্তির ভাণ্ডারীর খোজ করে । শুষ্ক তপস্যার পিছনে কোথায় আছে। অন্নপূর্ণার ভাণ্ডার । দিনের আলো যখন নিবে আসছে, সামনের অন্ধকারে যখন সন্ধ্যার তারা দেখা দিল, যখন জীবনযাত্রার বোঝা খালাস করে অনেকখানি বাদ দিয়ে অল্প-কিছু বেছে নেবার জন্যে মনকে তৈরি হতে হচ্ছে, তখন কোনটা রেখে কোনটা নেবার জন্যে মনের ব্যগ্ৰতা আমি তাই লক্ষ্য করে দেখছি। সমস্ত দিন প্ৰাণপণ চেষ্টায় যা-কিছু সে জমিয়েছিল, গড়ে তুলেছিল, সংসারের হাটে যদি তার কিছু দাম থাকে তবে তা সেইখানেই থােক, যারা আগলে রাখতে চায় তারাই তার খবরদারি করুক ; রইল টাকা, রইল খ্যাতি, রইল কীর্তি, রইল পড়ে বাইরে ; গোধূলির আঁধার যতই নিবিড় হয়ে আসছে ততই তারা ছায়া হয়ে এল ; তারা মিলিয়ে গেল মেঘের গায়ে সূর্যাস্তের বর্ণচ্ছটার সঙ্গে । কিন্তু, যে-অনাদি অন্ধকারের বুকের ভিতর থে” ক একদিন এই পৃথিবীতে বেরিয়ে এসেছি সেখানকার প্রচ্ছন্ন উৎসব থেকে উৎসারিত জলধারা ক্ষণে ক্ষণে আমার যাত্রাপথের পাশে পাশে মধুর কলস্বরে দেখা দিয়ে আমার তৃষ্ণা মিটিয়েছে, আমার তাপ জুড়িয়েছে, আমার ধুলো ধুয়ে দিয়েছে, সেই তীর্থের জল ভরে রইল আমার স্মৃতির পাত্ৰখানি । সেই অন্ধকার অপরিসীমের হৃদয়কন্দির থেকে বার বার যে-বাশির ধ্বনি আমার প্রাণে এসে সায়াহ্নে, বর্ষার নিশীথরাত্রে ; কত ধ্যানের শান্ডিতে, পূজার আত্মনিবেদনে, দুঃখের গভীরতায় ; কত দানে, কত গ্রহণে, কত ত্যাগে, কত সেবায়- তারা আমার দিনের পথে সুর হয়ে বেজেছিল, আজ তারাই আমার রাত্রের পথে দীপ হয়ে জ্বলে উঠছে । সেই অন্ধকারের ঝরনা থেকেই আমার জীবনের অভিষেক, সেই অন্ধকারের নিস্তব্ধতার মধ্যে আমার মৃত্যুর আমন্ত্রণ ; আজ আমি তাকে বলতে পারব, হে চিরপ্রচ্ছন্ন, আমার মধ্যে যা-কিছু তুমি তোমার গভীরের ভিতর থেকে তারার মতো প্ৰকাশ করেছ। রূপে ও বাণীতে, তাতেই নিত্যকালের অমৃত ; আমি খুঁজে খুঁজে পাথর কুড়িয়ে কুড়িয়ে কীর্তির যে-জয়স্তম্ভ গেঁথেছি, কালস্রোতের ভাঙনের উপরে তার ভিত । সেইজন্যেই আজ গোধূলির ধূসর আলোয় একলা বসে ভাবছিলুম, রঙিন রসের অক্ষরে লেখা যো-লিপি তোমার কাছ থেকে ক্ষণে ক্ষণে এসেছিল ভালো করে তা পড়া হয় নি, ব্যস্ত ছিলুম। তার মধ্যে নিমন্ত্রণ ছিল । কোথায় । কারখানাঘরে নয়, খাতাঞ্চিখানায় নয়, ছোটাে ছোটাে কোণে যেখানে ধরণীর ছোটাে সুখগুলি লুকানো । তাই আজ পিছন ফিরে তাকিয়ে মনে মনে ভেবে দেখছি, কতবার বঞ্চিত হলুম। জনতার জয়ধ্বনির ডাকে কতবার অন্যমনে গভীর নিভৃতের পাশ দিয়ে চলে এসেছি ; মায়ামৃগের অনুসরণে কতবার সরল সুন্দরের দিকে চোখ পড়ল না। জীবনপথে আশে পাশে সুধার-কণা-ভরা যে বিনামূল্যের ফলগুলি পাতার আড়ালে ঢাকা ছিল, তাদের এড়িয়ে উপবাসী হয়ে চলে এসেছি বলেই এত শ্রান্তি, এত অবসাদ । প্ৰভাত যেখান থেকে আপনি পেয়ালা আলোতে ভরে নেয়, রাত্রি যার আঙিনায় বসে প্ৰাণের ছিন্ন সূত্রগুলি বারে বারে জুড়ে তোলে, ঐ লুকিয়ে-থাকা ছোটাে ফলগুলি সেই মহান্ধকারেরই রহস্য-গৰ্ভ থেকে রস পেয়ে ফলে উঠছে, সেই অন্ধকার- যস্য ছায়ামৃতং যস্য মৃত্যুঃ । `ა Q {!'ა 'ა