পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 «۹ \\ রবীন্দ্র-রচনাবলী ক্রকোভিয়া জাহাজ ১৩ই ফেব্রুয়ারি ১৯২৫ বাংলা ভাষায় প্ৰেম অর্থে দুটাে শব্দের চল আছে ; ভালোলাগা আর ভালোবাসা । এই দুটাে শব্দে আছে প্ৰেমসমুদ্রের দুই উলটােপারের ঠিকানা । যেখানে ভালোলাগা সেখানে ভালো আমাকে লাগে, যেখানে ভালোবাসা সেখানে ভালো অন্যকে বাসি। আবেগের মুখটা যখন নিজের দিকে তখন ভালোলাগা, যখন অন্যের দিকে তখন ভালোবাসা । ভালোলাগায় ভোগের তৃপ্তি, ভালোবাসায় ত্যাগের ୪୩ ଅନୀ । সংস্কৃত ভাষায় অনুভব বলতে যা বুঝি তার খাটি বাংলা প্রতিশব্দ একদিন ছিল। এতবড়ো একটা চলতি ব্যবহারের কথা হারালো কোন ভাগ্যদোষে বলতে পারি নে। এমন দিন ছিল যখন লাজবাসা ভয়বাসা বলতে বোঝাত লজ্জা অনুভব করা, ভয় অনুভব করা । এখন বলি, লজ্জা পাওয়া, ভয় পাওয়া । কিল খাওয়া, গাল খাওয়া, যেমন ভাষার বিকার- লজ্জা পাওয়া, ভয় পাওয়াও তেমনি । কারও পরে আমাদের অনুভব যখন সম্পূর্ণ ভালো হয়ে ওঠে, ভালো-ভাবায় ভালো-ইচ্ছায় মন কানায় কানায় ভরতি হয় তখন তাকেই বলি ভালোবাসা। পূর্ণ উৎকর্ষের ভাবকেই বলা যায় ভালো । স্বাস্থ্য যেমন প্ৰাণের পূর্ণতা, সৌন্দর্য যেমন রূপের পূর্ণতা, সত্য যেমন জ্ঞানের পূর্ণতা, ভালোবাসা তেমনি অনুভূতির পূর্ণতা । ইংরেজিতে গুড় কীলিং বলে এ তা নয়, একে বলা যেতে পারে পারফেকটু কীলিং { শুভ-ইচ্ছার পূর্ণতা হচ্ছে নৈতিক, তার ক্রিয়া ব্যবহারের উপর ; ভালোবাসার পূর্ণতা আত্মিক, সে হচ্ছে মানুষের ব্যক্তিস্বরূপের (personalityর) পরম প্রকাশ ; শুভ-ইচ্ছা অন্ধকারে যষ্টি, প্রেম অন্ধকারে চাদ । মায়ের মেহমায়ের শুভ-ইচ্ছা মাত্র নয়, তা তার পূর্ণতার ঐশ্বর্য। তা অন্নের মতো নয়, তা অমৃতের মতো । এই অনুভূতির পূর্ণতা একটি শক্তি । ভালোবাসার বিষয়ের মধ্যে অসীমকে বোধ করবার শক্তি ; ব্যক্তিবিশেষের মধ্যে অপরিমেয়কে দেখতে পাওয়া এবং স্বীকার করাই অপরিমেয়কে সীমার মন্দিরে জাগিয়ে তোলবার শক্তি । নিজের অস্তিত্বের মূল্য যে-মানুষ ছোটাে করে দেখে আত্ম-অবিশ্বাসের অবসাদেই সে নিজের সম্পদ উদঘাটিত করতে ভরসা পায় না । বিশ্ব আপনার সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রত্যেক মানুষকে গ্রহণ ও ধারণ করে, মানুষের অন্তরে এই মস্ত সত্যটির অনুভব হচ্ছে প্ৰেম । ব্যক্তিবিশেষকে সে ডাক দিয়ে বলে, “তুমি কারোর চেয়ে কম নও, তোমার মধ্যে এমন মূল্য আছে যার জন্যে প্ৰাণ দেওয়া চলে ।” মানুষ যেখানে আপন সীমা টেনে দিয়ে নিজেকে সাধারণের শামিল করে অলস হয়ে বসে থাকে প্রেম ব্যক্তিবিশেষের সেই সাধারণ সীমাকে মানে না, তাকে অর্ঘ্য দিয়ে বলে, “তোমার কপালে আমি তিলক দিয়েছি, তুমি অসাধারণ।” সূর্যের আলো বৃষ্টির জল যেমন নির্বিচারে সর্বত্রই মাটির জড়তা ও দৈন্য অস্বীকার করে, মরুকে বার বার স্পর্শ করে, তাকে শ্যামলতায় পুলকিত করে তোলে, যে-ভূমি রিক্ত সমাজে প্ৰেম তেমনি সব জায়গাতেই অসীম প্রত্যাশা জাগিয়ে রাখে । ব্যক্তিকে সে যে মূল্য দেয়। সে মূল্য মহিমার মূল্য। অন্তর্নিহিত এই মহিমার আশ্বাসে মানুষের সৃষ্টিশক্তি নানাদিকে পূর্ণ হয়ে ওঠে ; তার কর্মের ক্লান্তি দূর হয়ে যায় । ܗܝ এই ব্যক্তিগত প্রেমের বাহন নারী । ইতিহাসের অপ্ৰকাশিত লিখন যদি বের করা যেত তা হলে দেখতে পেতাম নারীর প্রেমের প্রেরণা মানুষের সমাজে কী কাজ করেছে। শক্তির যে-ক্রিয়া উদ্যত চেষ্টারূপে চঞ্চল আমরা তাকেই শক্তির প্রকাশরাপে দেখি, কিন্তু যে-ক্রিয়া গৃঢ় উদ্দীপনারূপে পরিব্যাপ্ত তার কথা মনেই আনি নে। বিস্ময়ের কথা এই যে বিশ্বের স্ত্রীপ্ৰকৃতিকেই ভারতবর্ষ শক্তি বলে GeFGANGER I 引