পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী 8Գ Տ হলে বলতে হয়, মাছের ছানার সঙ্গে মানুষের শিশুর কোনো প্ৰভেদ নেই। অর্থাৎ, তার একমাত্র অর্থ বংশবৃদ্ধি । − কিন্তু, চিৎপ্রকৃতি সেই অর্থটাকে নিয়ে যখন আপনার চিন্ময় জিনিস করে তুললে, তখন তাকে চোর বদনাম দিয়ে মূলকেই মালেক স্বীকার করি যদি তা হলে শেকসপিয়ারেরও মাল থানায় আটক করতে হয়। মসলা আর মাল তো একই জিনিস নয় ; মাটির মালেক যদি হয় ভূপতি ভীড়ের মালেক তো কুমোর । আমাদের চিত্ত শিশুর মধ্যে সৃষ্টির অহৈতুক আনন্দটি দেখতে পায় । বয়স্ক মানুষের মধ্যে উদ্দেশ্য-উপায়-ঘটিত নানা তর্ক আছে ; কেউ বা কাজের কেউ বা অকাজের, কারও বা অর্থ আছে কারও বা নেই । কিন্তু শিশুকে যখন দেখি তখন কোনো প্ৰত্যাশার দ্বারা আচ্ছন্ন করে দেখি নে । সে-যে আছে, এই সত্যটাই বিশুদ্ধ ভাবে আমাদের মনকে টানে। সেই অপরিণত মানুষটির মধ্যে একটি পূর্ণতার ছবি দেখা দেয় । শিশুর মধ্যে মানুষের প্রাণময় রূপটি স্বচ্ছ অনাবিল আকাশে সুপ্ৰত্যক্ষ । নানা কৃত্রিম সংস্কারের ষড়যন্ত্রে তার সহজ আত্মপ্রকাশে একটুও দ্বিধা ঘটিয়ে দেয় না । প্ৰাণের বেগে নন্দিনী যে-রকম সহজে নেচেকুদে গোলমাল করে বেড়ায় আমি যদি তা করতে যাই, তা হলে যে-প্রভূত সংস্কারের পরিমণ্ডল আমাকে নিবিড় করে ঘিরে আছে সে-সুদ্ধ নড়াচড় করতে থাকে, সেটা একটা অসংগত ব্যাপার হয়ে ওঠে । শিশু যা-তা নিয়ে যেমন-তেমন করে খেলে, তাতেই খেলার বিশুদ্ধ রূপটি দেখি । খেলার উপকরণের কৃত্রিম মূল্য, খেলার লক্ষ্যের কৃত্রিম উত্তেজনা, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে না । নন্দিনী যখন লুব্ধভাবে কমললেবু খায় তখন সেই অসংকোচ লোভটিকে সুন্দর ঠেকে । সহজ প্ৰাণের রসবোধের সঙ্গে কমললেবুর যে মধুর সম্বন্ধ, ভদ্রতার কোনো বিধানের দ্বারা সেটা ক্ষুন্ন হয় নি। ঝগড়-বেহারটার প্রতি নন্দিনীর যে বন্ধুত্বের টান সেটা দেখতে ভালো লাগে, কেননা, যে-কোনো দুই মানুষের মধ্যে এই সম্বন্ধটি সত্য হওয়ার কোনো বাধা থাকা উচিত না । কিন্তু, সামাজিক ভেদবুদ্ধির নানা অভ্যন্ত সংস্কারকে যেমনি আমি স্বীকার করেছি। অমনি ঝগড়-বেহারিার সঙ্গে বন্ধুত্ব করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য হয়েছে ; অথচ এমন ভদ্রবেশধারীকে আমি সমকক্ষভাবে অনায়াসে গ্রহণ করতে পারি যার মনুষ্যত্বের আন্তরিক মূল্য ঝগড়র চেয়ে অনেক কম । জাহাজে তার সমবয়স্ক যুরোপীয় বালিকার সঙ্গে নন্দিনীর কাগড়াও হয়, ভাবও হয়, পরস্পরের মধ্যে সম্পত্তির বিনিময়ও চলছে। য়ুরোপীয় পুরুষযাত্রীর সঙ্গে মাঝে মাঝে আমার মাথা-নাড়ােনাড়ি হয়ে থাকে, শরীরের স্বাস্থ্য ও আবহাওয়া নিয়ে বাজে কথা বলাবলিও হয় ; সংস্কারের বেড়া ডিঙিয়ে তার বেশি আর সহজে এগোতে পারি নে। সহজ মানুষের সত্যটি সামাজিক মানুষের কুয়াশায় ঢেকে রেখে দেয়। অর্থাৎ আমরা নানা অবান্তর তথ্যের অস্বচ্ছতার মধ্যে বাস করি । শিশুর জীবনের যে সত্য তার সঙ্গে অবাস্তরের মিশোল নেই। তাই তার দিকে যখন চেয়ে দেখবার অবকাশ পাই তখন প্ৰাণলীলার প্রত্যক্ষ স্বরূপটি দেখি ; তাতে সংস্কারভারে পীড়িত চিন্তাক্লিষ্ট মন গভীর তৃপ্তি পায় । শিশুর মধ্যে আমরা মুক্তির সহজ ছবি দেখতে পাই। মুক্তি বলতে কী বোঝায়। প্রকাশের পূর্ণতা । ভগবান সম্বন্ধে প্রশ্নোত্তর ছলে কবি একটি চরম কথা বলেছেন : স ভগবঃ কস্মিন প্রতিষ্ঠিত ইতি। স্বে মহিম । সেই ভগবান কিসের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত । তার উত্তর, নিজের মহিমাতেই। অর্থাৎ, তিনি স্বপ্ৰকাশ । শিশুরাও সেই কথা । সে আপনাতে আপনি পরিব্যক্ত । তাকে দেখে আমাদের যে-আনন্দ সে তার বাধামুক্ত সহজ প্রকাশে । যুরোপে আজকাল চিত্রকলার ইতিহাসে একটা বিপ্লব এসেছে দেখতে পাই। এতকাল ধরে এই ছবি-আঁকার চার দিকে- হিন্দুস্থানি গানের তানকর্তব্যের মতোবে সমস্ত প্ৰভূত ওস্তাদি জমে উঠেছিল আজ সকলে বুঝেছে, তার বারো আনাই অবান্তর। তা সুঠাম হতে পারে, কোনো-না-কোনো কারণে মনোহর হতেও পারে, তার আড়ম্বর-বাহুল্যে বিশোব-একটা শক্তিসম্পদও প্রকাশ করতে পারে, অর্থাৎ ঝড়ের মেঘের মতো তার আশ্চর্য রঙের ঘটা থাকতে পারে, কিন্তু আসল যে জিনিসটি পড়েছে ঢাকা সে হচ্ছে সরল সত্যের সূৰ্য, যাকে স্বচ্ছ আকাশে তার আপনি নির্মল মহিমায় দেখে বিশ্ব আনন্দিত হয়।