পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী 8 Ե^Ֆ নানা বিশেষ সূত্রে বঁাধে, কাশীর মধ্যে যেন পৃথিবীর সেই বিশেষ দেশগত বন্ধনও নেই। অতএব, যথার্থ হিন্দুর কানে মৃত্যুর মুক্তিবাণী কাশীতে বিশুদ্ধ সুরে প্রবেশ করে । বর্তমান যুগে ন্যাশনাল বৈষয়িকতা বিশ্বব্যাপী হয়ে স্বদেশগত অহমিকাকে সুতীব্রভাবে প্ৰবল করে তুলেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই সংঘ-আশ্রিত অতি প্ৰকাণ্ডকায় রিপুই বর্তমান যুগের সমস্ত দুঃখ ও বন্ধনের কারণ । তাই, সেদিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার মনে হল, আমিও যেন মুক্তির তীর্থক্ষেত্রে মরতে পারি ; শেষ মুহুর্তে যেন বলতে পারি, সকল দেশই আমার এক দেশ, সর্বত্রই এক বিশ্বেশ্বরের মন্দির, সকল দেশের মধ্য দিয়েই এক মানবপ্রাণের পবিত্র জাহ্নবীধারা এক মহাসমুদ্রের অভিমুখে নিত্যকাল প্রবাহিত । ক্রকোভিয়া স্টিমার - sco QP3f. Sara পূর্বেই বলেছি, নন্দিনী তার নাম, তিন বছর তার বয়স, সে তৃতীয়ার চাদটুকুর মতো । আধুনিক নবেল পড়বার সময় তার এখনো হয় নি। ঘুম-পাড়াবার আগে তাকে গল্প শোনাবার লোক চাই । তাই, যে-আমি এতকাল জনসাধারণকে ঘুম পাড়াবার বায়না নিয়েছিলুম, দায়ে পড়ে সেই-আমার পদবৃদ্ধি হল । আজকাল এই ক্ষুদ্র মহারানীর শয্যাপার্থে আমার তলব হচ্ছে । কাল রাত্রে আহার সেরে জাহাজের কামরায় এসে বসেছি । হুকুম হল, “দাদামশায়, বাঘের গল্প বলে ।” আমি কবি ভবভূতির মতো বিনয় করে বললুম, “আমার সমযোগ্য লোক হয়তো জাহাজে এক-আধজন মিলতেও পারে, কারণ, যাত্রী অনেক এবং বিপুল চ তরণী ।” কিন্তু, নিষ্কৃতি পেলুম না । তখন শুরু করে দিলুম এক যে ছিল বাঘ, তার সর্ব অঙ্গে দাগ । আয়নাতে তাই হঠাৎ দেখে হল বিষম রাগ । ঝগড়কে সেই বললে ডেকে, “এখখনি তুই ভাগ, যা চলে তুই প্ৰাগ, সাবান যদি না মেলে তো যাস হাজারিবাগ।” বীনাপাপির কৃপা এইখানে এসে থেমে গেল, ছড়া আর এগোল না । তখন ছন্দের বেড়া ডিঙিয়ে গদ্যের মধ্যে নেমে পড়লুম। পাঠক নিশ্চয় বুঝতে পারছেন গল্পের মূল ধারাটা হচ্ছে, বাঘের সর্বাঙ্গণ কলঙ্কমোচনের জন্যে সাবান-অন্বেষণের দুঃসাধ্য অধ্যবসায়ে ঝগড়-নামধারী বোহারার যাত্ৰা । কথা উঠবে, ঝগড়র তাগিদটা কিসের। দয়ারও নয়, মৈত্রীরও নয়, ভয়ের তাগিদ । বাঘ শাসিয়েছিল, সাবান না। আনতে পারলে তার কান ছিড়ে নেবে । এতে বাস্তববিলাসীরা আশ্বস্ত হবেন, বুঝবেন, তা হলে গল্পটা নেহাত আজগুবি নয় । প্রথমে দেখাতে হল, পাথেয় এবং সাবানের মূল্যের জন্যে কী অসম্ভব উপায়ে ঝগড় একেবারে পাচ তিন নয়। সাত দশ পয়সা সংগ্ৰহ করলে । টেকে গুজে গোরুর গাড়ি করে সে বৃহস্পতিবারের বারবেলায় চেকোস্লোভাকিয়ায় রওনা হল । বোলপুরের কাছে ধোবাপাড়ার রাস্তায় আসতেই খামকা একটা ব্ৰাউন রঙের গাধা সাদা রঙের গোরুন্টার গা চোেট দিলে । বৰ্ণভেদে শ্ৰদ্ধাবান গোরুটা জাতিচু্যুতির ক্ষোভে গাড়িটা উলটিয়ে দিয়ে বন্ধনমুক্তভাবে চার পা তুলে সংসার ত্যাগ করে যাওয়াতে, সেই