পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

sv8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী অপঘাতে ঝগড়র পা ভেঙে তাকে রাস্তায় পড়ে থাকতে হল। বেলা বয়ে যায়, দূর থেকে ক্ষণে-ক্ষণে বাঘের ডাকও শোনা যাচ্ছে। এখন হতভাগার কান বঁাচে কী করে । এমন সময় ঝুড়ির্কাখে । জোড়ার্সাকোর মোক্ষদা চলেছে হাটে লাউশাক কিনতে । ঝগড় বললে, “মোক্ষদা, ও মোক্ষদা, তোমার ঝুড়িতে করে আমাকে ইস্টশনে পৌঁছিয়ে দাও।” মোক্ষদা যদি তখনই দয়া করে সহজে রাজি হত, তা হলে বাস্তবওয়ালার মতে সেটা বিশ্বাসযোগ্য হত না । তাই দেখাতে হল, ঝগড়, যখন টেকের থেকে দু-পয়সা নগদ দেবে। কবুল করলে তখনই মোক্ষদা। তাকে ঝুড়িতে তুলে নিলে । আশা করেছিলুম, গল্পের এই সন্ধিস্থলে এসে পৌঁছোবার পূর্বেই শ্রোত্রীর ঘুম আসবে। তার পরে, কাল আবার যদি আমাকে ধরে তা হলে উপসংহারে দেখাতে হবে, ভালোমানুষ ঝগড়র কানের তো কোনো অপচয় হলই না, বরঞ্চ পূর্বের চেয়ে এই প্রত্যঙ্গটা দীর্ঘতর হয়ে উঠে কানের বানানে দন্ত্য 'ন'কে মাত্রাছাড়া মূর্ধন্য ‘ণীয়ে খাড়া করে তোেলবার পক্ষে সাক্ষ্য দিলে । কেবল কাটা গেল ঐ দুষ্ট বাঘের লেজটা । সংসারে ধর্মের পুরস্কার ও অধর্মের তিরস্কার -মূলক উপদেশের সাহায্যে কলুষিত বঙ্গসাহিত্যে স্বাস্থ্যকর হাওয়া বইয়ে দেবার ইচ্ছাটাও আমার মনে ছিল । কিন্তু, গল্পের গোড়ায় নন্দিনীর চোখে যো-একটু ঘুমের আবেশ ছিল সেটা কেটে গিয়ে তার দৃষ্টি শরৎকালের আকাশের মতো জ্বলজ্বল করতে লাগল। ভয়ে হােক, ভক্তিতে হােক, বাঘ যদি বা ঝগড়র কানটা ছেড়ে দিতে রাজি হয় নন্দিনী গল্পটাকে ছাড়তে কিছুতেই রাজি হল না। অবশেষে দুই-চার জন আত্মীয়স্বজনের মধ্যস্থতায় কাল রাত্রির মতো ছুটি পেয়েছি। আর্টিস্ট বললেন, গল্পের প্রবাহে নানারকম ভেসে-আসা ছবি ওর মনকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে রাখছিল । তা হলেই তর্ক ওঠে, ছবির এমন কী গুণ আছে যাতে ঔৎসুক্য জাগিয়ে রাখে । কোনো দৃশ্য যখন বিশেষ করে আমাদের চোখ ভোলায় তখন কেন আমরা বলি, যেন ছবিটি । মুখ্যত ছবির গুণ হচ্ছে দৃশ্যতা । তাকে আহার করা নয়, ব্যবহার করা নয়, তাকে দেখা ছাড়া আর কোনো লক্ষ্যই নেই। তা হলেই বলতে হবে, যাকে আমরা পুরোপুরি দেখতে পাই তাকে আমাদের उठंब्ली व्ल८१ | यंदा’ নভাবে দেখি তাকে পুরো দেখি নে ; যাকে প্রয়োজনের প্রসঙ্গে দেখি তাকেও না ; র্যাকে দেখার জন্যেই দেখি তাকেই দেখতে পাই । বোলপুরের রাস্তায় গোরু, গাধা, গাড়ি উলটে ঝগড়র পা-ভাঙা প্রভৃতি দৃশ্যের দাম কিসেরই বা । চলতি ভাষায় যাকে মনোহর বলে এ তো তা নয় । কিন্তু, গল্পের বেগে তারা মনের সামনে এসে হাজির হচ্ছিল ; শিশুর মন তাদের প্রত্যেককেই স্বীকার করে নিয়ে বললে, “হা, এরা আছে ।” এই বলে স্বহস্তে এদের কপালে অস্তিত্বগৌরবের টীকা পরিয়ে দিলে । এই দৃশ্যগুলি গল্প-বলার বেষ্টনীর মধ্যে একটি বিশেষ ঐক্য লাভ করেছিল । বিশ্বের ছাড়া-ছাড়া সমস্ত ছড়ানো তথ্যের অস্পষ্টতা থেকে স্বতন্ত্র হয়ে তারা সুনির্দিষ্ট হয়ে উঠেছিল । এই জোরে তারা কেবলই দাবি করতে লাগল, “আমাকে দেখো !” সুতরাং, নন্দিনীর চোখের ঘুম আর किब्न ना । কবি বল, চিত্রী বল, আপনার রচনার মধ্যে সে কী চায়। সে বিশেষকে চায় । বাতাসে যে-অঙ্গারবাষ্প সাধারণভাবে আছে গাছ তাকে আত্মসাৎ করে আপনি ডালেপালায় ফলে ফুলে আপন ছন্দে রঙে অত্যন্ত বিশেষ করে যখন তোলে, তখনই তাতে সৃষ্টিলীলা প্রকাশ পায়। নীহারিকায় জ্যোতির্বাম্পি একটা একাকার ব্যাপার, নক্ষত্ৰ-আকারে বিশেষত্ব লাভ করায় তার সার্থকতা । মানুষের সৃষ্টিচেষ্টাও সেইরকম অনির্দিষ্ট সাধারণ থেকে সুনির্দিষ্ট বিশেষকে জাগাবার চেষ্টা । আমাদের মনের মধ্যে নানা হৃদয়াবেগ ঘুরে বেড়ায়। ছন্দে সুরে কথায় যখন সে বিশেষ হয়ে ওঠে তখন সে হয় কাব্য, সে হয় গান । হৃদয়া বেগকে প্ৰকাশ করা হল বলেই-যে আনন্দ তা নয় । তাকে বিশিষ্টতা দেওয়া হল বলেই আনন্দ । সেই বিশিষ্টতার উৎকর্ষেই তার উৎকর্ষ। মানুষের যে-কোনো রচনা সেই উৎকর্ষ পেয়েছে তাকেই আর্ট-সৃষ্টিরূপে দেখি ; সেই একান্ত দেখাতেই আনন্দ । ইংরেজি ভাষায় ক্যারেকটার শব্দের একটা অর্থ, স্বভাব, নৈতিক চরিত্র ; আর-একটা অর্থ, চরিত্ররূপ। অর্থাৎ, এমন কতকগুলি গুণের এমন সমাবেশ যাতে এই সমাবেশটি বিশেষভাবে