পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8S 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী ভারতের গ্রুনাে অনুষ্ঠানে দানের মতাে কােনাে দান করেছে শুনতে পাই নি। অথচ ভারত নিখ, ইংরেজ মিশনারি বিদ্যালয়ে ইংরেজের অর্থ আছে এমন কথা উঠবে । কিন্তু, সে কি ইংরেজের অর্থ। সে-যে খৃস্টিয়ানের অর্থ। সে-যে ধর্মফলকামী সমস্ত ইউরোপের অর্থ। ধামিকের দান, আত্মীয়তার দান নয়, অধিকাংশ সময়েই তা পারলৌকিক বৈষয়িকতার দান। ভারতীয় খৃস্টিয়ানের সঙ্গে ইংরেজ খৃস্টিয়ানের যে কি সম্বন্ধ তা সকলেই জানে। ভারতের কোনো একটি পাহাড়ের শহরে চার্চ অফ ইংলন্ডের সম্প্রদায়গত একজন ভারতীয় ভক্ত খৃস্টিয়ান ছিলেন। তার অন্ত্যেষ্টিসৎকারের অনুষ্ঠান নির্বাহের জন্য তার বিধবা স্ত্রী সেখানকার একমাত্র স্বসাম্প্রদায়িক পাদ্রিকে অনুরোধ করেন । পাদ্রি আপন মর্যাদাহানি করতে সম্মত হলেন না ; বোধ করি এতে পোলিটিকাল প্রেসিটিজেরও খর্বতাসম্ভাবনা আছে। অগত্যা বিধবা প্রেসবিটেরিয়ান পাদ্রির শরণাপন্ন হলেন ; তিনি ভিন্ন সম্প্রদায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দেওয়া অকর্তব্য বোধ করলেন । ভারতে কোনো যথার্থ ভক্ত ইংরেজ মিশনারি নেই, এ কথা আমি বলি নে । কিন্তু মিশনারি অনুষ্ঠানের যে-অংশে সাধারণ ইংরেজ ধামিকের অর্থ আছে সেখানে শ্রদ্ধা আছে। এ কথা মানব না । শ্রদ্ধয়া দেয়াম, অশ্রদ্ধয়া অদেয়ম । আমরা তো এই জানি, ভারতীয় চরিত্র ও ভারতীয় ধর্ম ও সমাজনীতির প্রতি সত্য মিথ্যা নানা উপায়ে অশ্রদ্ধা জাগিয়ে দিয়ে এই অর্থ সংগ্রহ হয়ে থাকে । অর্থাৎ, ভারতের প্রতি ইংরেজের যে-অবজ্ঞা ইংরেজ ধর্মব্যবসায়ীরা সর্বদাই তার ভূমিকা পত্তন ও ভিত্তি দৃঢ় করে এসেছে, সেখানকার শিশুদের মনে তারা খুস্টের নাম করে ভারতীয়ের প্রতি অগ্ৰীতির বীজ বপন করেছে। সেই বড়ো হয়ে যখন শাসনকর্তা হয় তখন জালিয়ানওয়ালাবাগের অমানুষিক হত্যাকাণ্ডকেও ন্যায়সংগত বলে বিচারকের আসন থেকে ঘোষণা করতে লজা বোধ করে না । যেমন অশ্রদ্ধা তেমনি কাপণ্য ।-- আমাদের পক্ষে সকলের চেয়ে প্ৰধান ও সাধারণ আবরণ হচ্ছে অভ্যাসের মোহ । এই অভ্যাসে চেতনায় যে-জড়তা আসে তাতে সত্যের অনন্তরূপ আনন্দরূপ দেখতে দেয় না । শিক্ষাবিধি সম্বন্ধে এই তত্ত্বটাকে আমরা একেবারেই অগ্রাহ্য করেছি । ছাত্রদের প্রতিদিন একই ক্লাসে একই সময়ে একই বিষয়ে শিক্ষার পুনরাবৃত্তি করানোর চেয়ে মনের জড়ত্বের কারণ আর কিছুই হতে পারে না । শিক্ষা সম্বন্ধে ছাত্রদের প্রধানত যে-বিতৃষ্ণা জন্মে শিক্ষার বিষয় কঠিন বলেই যে তা ঘটে তা সম্পূর্ণ সত্য নয় ; শিক্ষাবিধি অত্যন্ত একঘেয়ে বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। মানুষের প্রাণ যন্ত্রকে ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু যন্ত্রকে আত্মীয় করতে পারে না ; শিক্ষাকে যন্ত্র করে তুললে তার থেকে কোনো বাহ্য ফলই হয় না। তা নয়, কিন্তু সে শিক্ষা আত্মগত হতে গুরুতর বাধা পায় । আকস্মিক হচ্ছে সীমার বাইরেকার দূত, অভাবনীয়দের বার্তা নিয়ে সে আসে। তাতেই আমাদের চেতনা জড়তা থেকে মুক্তির আনন্দ পায় । অভাবনীয়কে অনুভব করাতেই তার মুক্তি । বিশ্বের সর্বত্রই সেই অভাবনীয় । এই অভাবনীয়কে বোধের মধ্যে আনতে গেলে চিত্তকে প্ৰাণবান করে রাখা চাই, অর্থাৎ তাকে উৎসুক করে তুলতে হয় । এই ঔৎসুক্যই তাকে বদ্ধতার সীমার দিক থেকে বৃদ্ধির অসীমতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। অথচ, প্ৰাণের এই ঔৎসুক্য নষ্ট করে দিয়ে পুনরাবৃত্তির অন্ধ প্ৰদক্ষিণের জোয়ালে জোর করে চিত্তকে জুড়ে দেওয়াকেই অনেকে ডিসিপ্লিন বলে গৌরব করেন । অর্থাৎ, বিধাতা যে-মানুষকে প্রাণী করেছে সেই মানুষকেই তারা যন্ত্র করতে চান । সেটা হয় সিদ্ধির * লোভে । যন্ত্র হচ্ছে সিদ্ধিদেবীর বাহন, প্ৰাণকে পিষে সে প্রবল হয় । বিশেষ নির্দিষ্ট কোনো-একটা সংকীর্ণ ফল দেওয়াই তার কাজ । বিশ্বাসত্যে নিদিষ্টের চারি দিকে যে অসীম অনির্দিষ্ট আছে তাকে সে দেখতে পারে না, কেননা, প্ৰাণকে সে কেবলই গণ্ডীর বাহিরে আহবান করে । গণ্ডির বাহিরে বিধাতার বঁশি বাজে ; ফলকামী সেই ধ্বনি রুদ্ধ করে প্রাচীর তোলে । আমার মতে শিক্ষার প্রণালী হচ্ছে বৈরাগীর রাস্তায় । ছাত্রদের নিয়ে বিবাগী হয়ে বেরিয়ে পড়তে হয় । চলতে চলতে নিয়ত নব নব বিস্ময়ে অজানার ভিতর দিয়ে জেনে চলাই হচ্ছে প্ৰাণবান শিক্ষা | প্ৰাণের ছন্দের সঙ্গে এই শিক্ষাপ্রবাহের তাল মেলে । বদ্ধ ক্লাস হচ্ছে প্ৰাণধমী চিত্তের সহজজ্ঞানের