পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8NV রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী কাছে তার ছন্দের রূপে সহজেই সত্তারহস্যের কী একটা নিবিড় পরিচয় দেয় । সে কোনো বাধা দেয় না। প্রতিদিন হাজার জিনিসকে যা না বলি, তাকে তাই বলি ; বলি, “তুমি আছি।” একদিন আমার মালী ফুলদানি থেকে বাসি ফুল ফেলে দেবার জন্যে যখন হাত বাড়ালো, বৈষ্ণবী তখন ব্যথিত হয়ে বলে উঠল, “লিখতে পড়তেই তোমার সমস্ত মন লেগে আছে, তুমি তো দেখতে পাও না।” তখনই চমকে উঠে আমার মনে পড়ে গেল, হঁহা, তাই তো বটে। ঐ বাসি’ বলে একটা অভ্যন্ত কথার আড়ালে ফুলের সত্যকে আর আমি সম্পূর্ণ দেখতে পাই নে। যে আছে সেও আমার কাছে নেই ; নিতান্তই অকারণে, সত্য থেকে, সুতরাং আনন্দ থেকে বঞ্চিত হলুম। বৈষ্ণবী সেই বাসি ফুলগুলিকে অঞ্চলের মধ্যে সংগ্রহ করে তাদের চুম্বন করে নিয়ে চলে গেল । আর্টিস্ট তেমনি করে আমাদের চমক লাগিয়ে দিক । তার ছবি বিশ্বের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে দিয়ে বলুক, “ঐ দেখো, আছে।” সুন্দর বলেই আছে তা নয়, আছে বলেই সুন্দর। সত্তাকে সকলের চেয়ে অব্যবহিত ও সুস্পষ্ট করে অনুভব করি আমার নিজের মধ্যে । “আছি” এই ধ্বনিটি নিয়তই আমার মধ্যে বাজছে । তেমনি স্পষ্ট করে যেখানেই আমরা বলতে পারি। “আছে।” সেখানেই তার সঙ্গে, কেবল আমার ব্যবহারের অগভীর মিল নয়, আত্মার গভীরতম মিল হয় । “আছি” অনুভূতিতে আমার যে-আনন্দ, তার মানে এ নয় যে, আমি মাসে হাজার টাকা রোজগার করি বা হাজার লোকে আমাকে বাহবা দেয়। তার মানে হচ্ছে এই যে, আমি যে সত্য এটা আমার কাছে নিঃসংশয়, তর্ক করা সিদ্ধান্তের দ্বারা নয়, নিবিচার একান্ত উপলব্ধির দ্বারা । বিশ্বে যেখানে তেমনি একান্তভাবে “আছে।” এই উপলব্ধি করি সেখানে আমার সত্তার আনন্দ বিস্তীর্ণ হয় । সত্যের ঐক্যকে সেখানে ব্যাপক করে জানি । GKPiGn rafi trafGr Wilas RafG ver fisik kegaga- the True, the Good, the Beautiful । ব্ৰাহ্মসমাজে তারই একটি সংস্কৃত তর্জমা খুব চলতি হয়েছে- সত্যং শিবং সুন্দরম। এমন-কি, অনেকে মনে করেন, এটি উপনিষদের বাণী । উপনিষৎ সত্যের স্বরূপ যে ব্যাখ্যা করেছেন সে হচ্ছে, শান্তং শিবং অদ্বৈতম। শান্তং হচ্ছে সেই সামঞ্জস্য যার যোগে সমস্ত গ্ৰহতারা নিয়ে বিশ্ব শান্তিতে বিধূত, যার যোগে কালের গতি চিরন্তন ধূতির মধ্যে নিয়মিত ; নিমেষ মুহুর্তাণ্যধর্মসা ঋতবঃ সংবৎসরা ইতি বিধৃতাস্তিষ্ঠন্তি - শিবং হচ্ছে মানবসমাজের মধ্যে সেই সামঞ্জস্য যা নিয়তই কল্যাণের মধ্যে বিকাশ লাভ করছে, যার অভিমুখে মানুষের চিত্তের এই প্রার্থনা যুগে যুগে সমস্ত বিরোধের মধ্য দিয়েও গৃঢ়ভাবে ও প্রকাশ্যে ধাবিত হচ্ছে: অসতো মা সদগময় তমসো মা জ্যোতিৰ্গময় মৃত্যোর্মামৃতং গময় । আর, অদ্বৈতং হচ্ছে আত্মার মধ্যে সেই ঐক্যের উপলব্ধি যা বিচ্ছেদের ও বিদ্বেষের মধ্য দিয়েও আনন্দে প্ৰেমে নিয়ত আত্মীয়তাকে ব্যাপ্ত করছে । র্যাদের মন খুস্টিয়ানতত্ত্বের আবহাওয়াতে অত্যন্ত অভ্যস্ত তারা উপনিষৎ সম্বন্ধে ভয়ে ভয়ে থাকেন, খৃস্টিয়ান দার্শনিকদের নমুনার সঙ্গে মিলিয়ে উপনিষদের বাণীকে কিছু-না-কিছু বদল করে চালিয়ে দেওয়া তাদের ভিতরকার ইচ্ছা । কিন্তু, শান্তং শিবং অদ্বৈতম। এই মন্ত্রটিকে চিন্তা করে দেখলেই তারা এই আশ্বাস পাবেন যে, অসীমের মধ্যে দ্বন্দ্বের অভাবের কথা বলা হচ্ছে না, অসীমের মধ্যে দ্বন্দ্বের সামঞ্জস্য এইটেই তাৎপৰ্য । কারণ, বিপ্লব না থাকলে শান্তির কোনো মানেই নেই, মন্দ না থাকলে ভালো একটা শব্দমাত্র, আর বিচ্ছেদ না থাকলে অদ্বৈত নিরর্থক । তারা যখন সত্যের ত্ৰিগুণাত্মক ধ্যানের মন্ত্র স্বরূপে সত্যং শিবং সুন্দরম বাক্যটি ব্যবহার করেন তখন তাদের বোঝা উচিত যে, সত্যকে সত্য বলাই বাহুল্য এবং সুন্দর সত্যের একটা তত্ত্ব নয়, আমাদের অনুভূতিগত বিশেষণমাত্র, সত্যের তত্ত্ব হচ্ছে অদ্বৈত । যে-সত্য বিশ্বপ্রকৃতি লোকসমাজ ও মানবাত্মা পূর্ণ করে আছেন তার স্বরূপকে ধ্যান করবার সহায়তাকল্পে 'শান্তং শিবং অদ্বৈতম মন্ত্রটি যেমন সম্পূর্ণ উপযোগী এমন আমি তো আর কিছুই জানি নে । মানবসমাজে যখন শিবকে পাবার সাধনা করি তখন কল্যাণের উপলব্ধিকে শান্তং আর অদ্বৈতং এই দুই-এর মাঝখানে রেখে দেখি, অর্থাৎ ইংরেজিতে বলতে গেলে, ল এবং লভ এর পূর্ণতাই হচ্ছে সমাজের ওয়েলফেয়ার। ,