পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(*OR রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী স্পর্শ করেছে। সর্বত্রই মানুষের সুপ্ত শক্তির দ্বারে তার আঘাত এসে পড়ল। প্রভূতের দ্বারাই তার প্রভাব । যুরোপ সর্বদেশ সর্বকালকে যে স্পর্শ করেছে সে তার কোন সত্য দ্বারা। তার বিজ্ঞান সেই সত্য । তার যে-বিজ্ঞান মানুষের সমস্ত জ্ঞানের ক্ষেত্ৰকে অধিকার করে কর্মের ক্ষেত্রে জয়ী হয়েছে সে একটা বিপুল শক্তি । এইখানে তার চাওয়ার অন্ত নেই, তার পাওয়াও সেই পরিমাণে । গত বছর যুরোপ থেকে আসবার সময় একটি জর্মন যুবকের সঙ্গে আমার আলাপ হয় । তিনি তার অল্পবয়সের স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ভারতবর্ষে আসছিলেন । মধ্যভারতের আরণ্য প্রদেশে যে-সব জাতি প্ৰায় অজ্ঞাতভাবে আছে দুবৎসর তাদের মধ্যে বাস করে তাদের রীতিনীতি তন্ন তন্ন করে জানতে চান । এরই জন্যে র্তারা দুজনে প্ৰাণপণ করতে কুষ্ঠিত হন নি। মানুষসম্বন্ধে মানুষকে আরো জানতে হবে, সেই আরো জানা বর্বর জাতির সীমার কাছে এসেও থামে না । সমস্ত জ্ঞাতব্য বিষয়কে এইরকম সংঘবদ্ধ করে জানা, বৃহবদ্ধ করে সংগ্ৰহ করা, জানিবার সাধনায় মনকে সম্পূর্ণ মোহমুক্ত করা, এতে করে মানুষ যে কত প্ৰকাণ্ড বড়ো হয়েছে। যুরোপে গেলে তা বুঝতে পারা যায়। এই শক্তি দ্বারা পৃথিবীকে যুরোপ মানুষের পৃথিবী করে সৃষ্টি করে তুলছে। যেখানে মানুষের পক্ষে যা-কিছু বাধা আছে তা দূর করবার জন্যে সে যে-শক্তি প্রয়োগ করছে তাকে যদি আমরা সামনে মূর্তিমান করে দেখতে পেতুম তা হলে তার বিরাট রূপে অভিভূত হতে হত । এইখানে য়ুরোপের প্রকাশ যেমন বড়ো, যাকে নিয়ে সকল মানুষ গর্ব করতে পারে, তেমনি তার এমন একটা দিক আছে যেখানে তার প্রকাশ আচ্ছন্ন । উপনিষদে আছে, যে-সাধকেরা সিদ্ধিলাভ করেছেন- তে সর্বগং সর্বতঃ প্ৰাপ্য ধীরা যুক্তাত্মানঃ সর্বমেবাবিশন্তি : তারা সর্বগামী সত্যকে সকল দিক থেকে লাভ করে যুক্তাত্মভাবে সমস্তের মধ্যে প্রবেশ করেন । সত্য সর্বগামী বলেই মানুষকে সকলের মধ্যে প্রবেশাধিকার দেয় । বিজ্ঞান বিশ্বপ্ৰকৃতির মধ্যে মানুষের প্রবেশপথ খুলে দিচ্ছে ; কিন্তু আজ সেই যুরোপে এমন একটি সত্যের অভাব ঘটেছে যাতে মানুষের মধ্যে মানুষের প্রবেশ অবরুদ্ধ করে । অন্তরের দিকে যুরোপ মানুষের পক্ষে একটা বিশ্বব্যাপী বিপদ হয়ে উঠল । এইখানে বিপদ তার নিজেরাও । এই জাহাজেই একজন ফরাসি লেখকের সঙ্গে আমার আলাপ হল । তিনি আমাকে বলছিলেন, যুদ্ধের পর থেকে যুরোপের নবীন যুবকদের মধ্যে বড়ো করে একটা ভাবনা ঢুকেছে। এই কথা তারা বুঝেছে, তাদের আইডিয়ালে একটা ছিদ্র দেখা দিয়েছিল যে-ছিদ্র দিয়ে বিনাশ ঢুকতে পারলে। অর্থাৎ কোথাও তারা সত্যভ্ৰষ্ট হল এতদিনে সেটা ধরা পড়েছে । মানুষের জগৎ অমরাবতী, তার যা সত্য-ঐশ্বর্য তা দেশে কালে পরিমিত নয় । নিজের জন্য নিয়ত মানুষ এই-যে অমরলোক সৃষ্টি করছে তার মূলে আছে মানুষের আকাঙক্ষা করবার অসীম সাহস । কিন্তু, বড়োকে গড়বার উপকরণ মানুষের ছোটাে যেই চুরি করতে শুরু করে আমনি বিপদ ঘটায় । মানুষের চাইবার অন্তহীন শক্তি যখন সংকীর্ণ পথে আপন ধারাকে প্রবাহিত করতে থাকে তখনই কৃল ভাঙে, তখনই বিনাশের বন্যা দুৰ্দাম হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, মানুষের বিপুল চাওয়া ক্ষুদ্র-নিজের জন্যে হলে তাতেই যত অশান্তির সৃষ্টি । যেখানে তার সাধনা সকলের জন্যে সেইখানেই মানুষের আকাঙক্ষা কৃতাৰ্থ হয় । এই সাধনাকেই গীতা যজ্ঞ বলেছেন ; এই যজ্ঞের দ্বারাই লোক রক্ষা । এই যজ্ঞের পস্থা হচ্ছে নিষ্কাম কর্ম। সে-কর্ম দুর্বল হবে না, সে-কর্ম ছোটাে হবে না, কিন্তু সে-কর্মের ফলকামনা যেন নিজের छ८J - | বিজ্ঞান যে বিশুদ্ধ তপস্যার প্রবর্তন করেছে সে সকল দেশের, সকল কালের, সকল মানুষেরএইজন্যেই মানুষকে তাতে দেবতার শক্তি দিয়েছে, সকলরকম দুঃখ দৈন্য পীড়াকে মানবলোক থেকে দূর করবার জন্যে সে অস্ত্ৰ গড়ছে ; মানুষের অমরাবতী নির্মাণের বিশ্বকর্ম এই বিজ্ঞান । কিন্তু, এই বিজ্ঞানই কর্মের রূপে যেখানে মানুষের ফলকামনাকে অতিকায় করে তুললে সেইখানেই সে হল যমের বাহন। এই পৃথিবীতে মানুষ যদি একেবারে মরে তবে সে এইজন্যেই মরবে- সে সত্যকে জেনেছিল