পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ο Σ. Ν. রবীন্দ্র-রচনাবলী মর্তলোকে প্রয়োজন বলে জিনিসটাকে একেবারেই অস্বীকার করতে পারি নে। বেঁচে থাকবার জন্যে আহার করতেই হবে । বলতে পারব না, “নেই বা করলেম ।” সেই আবশ্যকের তাড়াতেই পরের দ্বারে মানুষ উমেদারি করে, আর সেইসঙ্গেই তত্ত্বজ্ঞানী ভাবতে থাকে কী করলে এই কর্মের জড় মারা যায়। বিদ্রোহী মানুষ বলে বসে, বৈরাগ্যমেবাভয়ম। অর্থাৎ, এতই কম খাব, কম পরব, রৌদ্রবৃষ্টি এমন করে করেছে সেগুলোকে এতটা এড়িয়ে চলাব যে, কর্মের দায় অত্যন্ত হালকা হয়ে যাবে। কিন্তু, প্ৰকৃতির কাজে শুধু কানমলার তাড়া নেই, সেইসঙ্গে রসের জোগান আছে। এক দিকে ক্ষুধায় দেয় দুঃখ, কাজ করায় । সেই লোভের দিক থেকে আমাদের মনে জন্মায় ভোগের ইচ্ছা । বিদ্রোহী মানুষ বলে, ঐ ভোগের ইচ্ছাটা প্ৰকৃতির চাতুরী, ঐটেই মোহ, ওটাকে তাড়াও, বলো, বৈরাগ্যমেবাভিয়াম- মানব না। দুঃখ, চাইব না সুখ । দু-চারজন মানুষ এমনতরো স্পর্ধা করে ঘরবাড়ি ছেড়ে বনে জঙ্গলে ফলমূল খেয়ে কাটাতে পারে, কিন্তু সব মানুষই যদি এই পন্থা নেয় তা হলে বৈরাগ্য নিয়েই পরস্পর লড়াই বেধে যাবে- তখন । বন্ধলে কুলোবে না, গিরিগহবরে ঠেলাঠেলি ভিড় হবে, ফলমূল যাবে উজাড় হয়ে । তখন কপনি পরা ফৌজ মেশিন-গান বের করবে । সাধারণ মানুষের সমস্যা এই যে, কর্ম করতেই হবে । জীবনধারণের গোড়াতেই প্রয়োজনের তাড়া আছেই। তবুও কী করলে কর্ম থেকে প্রয়োজনের চাপ যথাসম্ভব হালকা করা যেতে পারে । অর্থাৎ, কী করলে কর্মে পরের দাসত্বের চেয়ে নিজের কর্তৃত্বটা বড়ো হয়ে দেখা দেয় । কর্ম থেকে কর্তৃত্বকে যতই দূরে পাঠানো যাবে কর্ম ততই মজুরির বোঝা হয়ে মানুষকে চেপে মারবে ; এই শূদ্রুত্ব থেকে মানুষকে উদ্ধার করা চাই । একটা কথা মনে পড়ে গেল । সেদিন যখন শিলঙে ছিলেম, নন্দলাল কার্সিয়ঙ থেকে পোস্টকার্ডে একটি ছবি পাঠিয়েছিলেন । স্যাকরা চার দিকে ছেলেমেয়েদের নিয়ে চোখে চশমা ঐাটে গয়না গড়ছে। ছবির মধ্যে এই কথাটি পরিস্ফুট যে, এই স্যাকরার কাজের বাইরের দিকে আছে তার দর, ভিতরের দিকে আছে তার আদর । এই কাজের দ্বারা স্যাকরা নিছক নিজের অভাব প্ৰকাশ করছে না, নিজের ভাবকে প্ৰকাশ করছে ; আপনি দক্ষতার গুণে আপন মনের ধ্যানের মূর্তি দিচ্ছে । মুখ্যত এ-কাজটি তার আপনারই, গৌণত যে-মানুষ পয়সা দিয়ে কিনে নেবে তার । এতে করে ফলকামনাটা হয়ে গেল লঘু মূল্যের সঙ্গে অমূল্যতার সামঞ্জস্য হল, কর্মের শূদ্ৰত্ব গোল ঘুচে । এককালের বণিককে সমাজ অবজ্ঞা করত, কেননা, বণিক কেবল বিক্রি করে, দান করে না । কিন্তু, এই স্যাকরা এই-যে, গয়নাটি গড়লে তার মধ্যে তার দান এবং বিক্রি একই কালে মিলে গেছে । সে ভিতর থেকে দিয়েছে, বাইরে থেকে জোগায় নি । ভূত্যকে রেখেছি তাকে দিয়ে ঘরের কাজ করাতে । মনিবের সঙ্গে তার মনুষ্যত্বের বিচ্ছেদ একান্ত হলে সেটা হয় যোলো আনা দাসত্ব । যে-সমাজ লোভে বা দাক্তিকতায় মানুষের প্রতি দরদ হারায় নি সে-সমাজ ভূত্য আর আগ্ৰীয়ের সীমারেখাটাকে যতদূর সম্ভব ফিকে করে দেয়। ভূত্য সেখানে দাদা খুড়ো জেঠার কাছাকাছি গিয়ে পীেছয় । তখন কাজটা পরের কাজ না হয়ে আপনারই কাজ হয়ে ওঠে । তখন তার কাজের ফলকামনটা যায় যথাসম্ভব ঘুচে । সে দাম পায় বটে, তবুও আপনার কাজ সে দান করে, বিক্রি করে না । , গুজরাটে কাঠিয়াবাড়ে দেখেছি, গোয়ালা গোরুকে প্ৰাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে । সেখানে তার দুধের ব্যবসায়ে ফলকামনাকে তুচ্ছ করে দিয়েছে তার ভালোবাসায় ; কর্ম করেও কর্ম থেকে তার নিত্য মুক্তি । এ গোয়ালা শূদ্র নয়। যে-গোয়ালা দুধের দিকে দৃষ্টি রেখেই গোরু পোষে, কসাইকে গোরু বেচিতে যার বাধে না, সেই হল শূত্র ; কর্মে তার আগীেরব, কর্ম তার বন্ধন । যে-কর্মের অন্তরে মুক্তি নেই, যেহেতু তাতে কেবল লোভ, তাতে প্রেমের অভাব, সেই কর্মেই শূদ্ৰন্থ । জগত-শূদ্রেরা পৃথিবীতে