পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ο Σ. Ν9 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী যায়, হিন্দুতে হিন্দুতে তা লাগে না । এইজন্যেই হিন্দুর ঐক্য আপন বিপুল অংশপ্ৰত্যংশ নিয়ে কেবলই নড়নড় করছে। মুসলমান যেখানে আসে। সেখানে সে-যে কেবলমাত্র আপনি বল দেখিয়ে বা যুক্তি দেখিয়ে বা চরিত্র দেখিয়ে সেখানকার লোককে আপনি সম্প্রদায়ভুক্ত করে তা নয়, সে আপন সন্ততিবিস্তার দ্বারা সজীব ও ধারাবাহিক ভাবে আপন ধর্মের বিস্তার করে । স্বজাতির, এমন-কি, পরজাতির লোকের সঙ্গে বিবাহে তার কোনো বাধা নেই । এই অবাধ বিবাহের দ্বারা সে আপন সামাজিক অধিকার সর্বত্র প্রসারিত করতে পারে । কেবলমাত্র রক্তপাতের রাস্তা দিয়ে নয়, রক্তমিশ্রণের রাস্তা দিয়ে সে দূরে দূরান্তরে প্রবেশ করতে পেরেছে। হিন্দু যদি তা পারত তা হলে বালিদ্বীপে হিন্দুধর্ম স্থায়ী বিশুদ্ধ ও পরিব্যক্ত হতে দেরি হত না । ১ আগস্ট ১৯২৭ * r গোলমাল ঘোরাফেরা দেখাশোনা বলাকওয়া নিমন্ত্রণ-আমন্ত্রণের ফাকে ফাকে যখন-তখন দু-চার লাইন করে লিখি, ভাবের স্রোত আটকে আটকে যায়, তার সহজ গতিটা থাকে না । একে চিঠি বলা চলে না। কেননা, এর ভিতরে ভিতরে কর্তব্যপরায়ণতার ঠেলা চলছে- সেটাতে কাজকে এগিয়ে দেয়, ভাবকে হয়রান করে । পাখি-ওড়ায় আর ঘুড়ি-ওড়ায় তফাত আছে । আমি ওড়াচ্ছি চিঠির ছলে লেখার ঘুড়ি, কর্তব্যের লাঠাইয়ে বাধা, কেবলই হেঁচকে হেঁচকে ওড়াতে হয় । ক্লান্ত হয়ে পড়েছি । দিনের মধ্যে দু-তিনরকমের প্রোগ্রাম । নতুন নতুন জায়গায় বক্ততা নিমন্ত্রণ ইত্যাদি ৷ গীতার উপদেশ যদি মানতুম, ফললাভের প্রত্যাশা। যদি না থাকত, তা হলে পাল-তোলা নীেকার মতো জীবনতরণী তীর থেকে তীব্রান্তরে নেচে নেচে যেতে পারত । চলেছি উজান বেয়ে, গুন টেনে, লাগি ঠেলে দাড় বেয়ে ; পদে পদে জিব বেরিয়ে পড়ছে । আমৃত্যুকাল কোনোদিন কোথাও-যে সহজে ভ্ৰমণ করতে পারব সে আশা বিড়ম্বনা । পথ সুদীর্ঘ, পাথেয় স্বল্প ; অর্জন করতে করতে গর্জন করতে করতে, হােটেলে হােটেলে ডলার বর্জন করতে করতে, আমার ভ্রমণ— গলা চালিয়ে আমার পা চালানো । পথে বিপথে যেখানে-সেখানে আচমকা আমাকে বক্ততা করতে বলে, আমিও উঠে দাড়িয়ে বকে যাই— আমেরিকায় মুড়ি তৈরি করবার কলের মুখ থেকে যেমন মুড়ি বেরোতে থাকে সেইরকম । হাসিও পায় দুঃখও ধরে । পৃথিবীর পনেরো-আনা লোক কবিকে নিয়ে সর্বসমক্ষে এইরকম অপদস্থ করতেই ভালোবাসে ; বলে, “ মেসেজ দাও ।” মেসেজ বলতে কী বুঝায় সেটা ভেবে দেখো । সর্বসাধারণ নামক নির্বিশেষ পদার্থের উদাসীন কানের কাছে অত্যন্ত নির্বিশেষ ভাবের উপদেশ দেওয়া, যা কোনো বাস্তব মানুষের কোনো বাস্তব কাজেই লাগে না । পরলোকগত বহুসংখ্যক পিতৃপুরুষদের উদ্দেশে পাইকেরি প্রথায় পিণ্ডি দেওয়ার মতো— যেহেতু সে-পিণ্ড কেউ খায় না। সেইজন্যে তাতে না আছে স্বাদ, না আছে শোভা । যেহেতু সেটা রসনাহীন ও ক্ষুধাহীন নামমাত্রের জন্য উৎসগ করা সেই জন্যে সেটাকে যথার্থ খাদ্য করে তোলার জন্যে কারও গরজ নেই । মেসেজ-রচনা সেইরকম রচনা । আজ বিকেলের গাড়িতে পিন্যাঙ যেতে হবে । তার আগে, যদি সুসাধ্য হয় তবে নাওয়া আছে, খাওয়া আছে ; যদি দুঃসাধ্য হয় তবু একটা মিটিঙে গিয়ে বক্তৃতা আছে ; ঘুম নেই, বিশ্রাম নেই, শান্তি ১ নির্মলকুমারী মহলানবিশকে লিখিত ।