পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ &や ह्नर्देीट्झ-ब्रष्न्षांदळेी এর থেকে বোঝা যায়, কেবল ভাবের আবেগ নয়, ঘটনা-বর্ণনাকেও এরা নাচের আকারে গড়ে তোলে। মানুষের সকল ঘটনারই বাহ্যরূপ চলাফেরায় । কোনো একটা অসামান্য ঘটনাকে পরিদৃশ্যমান করতে চাইলে তার চলাফেরাকে ছন্দের সুষমাযোগে রূপের সম্পূর্ণতা দেওয়া সংগত । বাণীর দিকটাকে বাদ দিয়ে কিংবা খাটো করে কেবলমাত্র গতিরূপটিকে ছন্দের উৎকর্ষ দেওয়া এখানকার নাচ । পৌরাণিক যে-আখ্যায়িকা কাব্যে কেবলমাত্র কানে শোনার বিষয়, এরা সেইটোকেই কেবলমাত্র চোখে দেখার বিষয় করে নিয়েছে। কাব্যের বাহন বাক্য, সেই বাক্যের ছন্দ-অংশ সংগীতের বিশ্বজনীন নিয়মে চালিত ; কিন্তু তার অর্থ-অংশ কৃত্রিম, সেটা সমাজে পরস্পরের আপসে তৈরি-করা সংকেতমাত্র । দুইয়ের যোগে কাব্য । গাছ শব্দটা শুনলে গাছ তারাই দেখে যাদের মধ্যে এ সম্বন্ধে একটা আপসে বোঝাপড়া আছে। তেমনি এদের নাচের মধ্যে শুধু ছন্দ থাকলে তাতে আখ্যানবৰ্ণনা চলে না, সংকেতও আছে ; এই দুইয়ের যোগে এদের নাচ । এই নাচে রসনা বন্ধ করে এরা সমস্ত দেহ দিয়ে কথা কইছে ইঙ্গিতে এবং ভঙ্গিসংগীতে । এদের নাচে যুদ্ধের যে-রূপ দেখি কোনো রণক্ষেত্রে সেরকম যুদ্ধ দূরতঃও সম্ভব নয় । কিন্তু যদি কোনো স্বর্গে এমন বিধি থাকে যে, ছন্দে যুদ্ধ করতে হবে, এমন যুদ্ধ যাতে ছন্দ-ভঙ্গ হলে সেটা পরাভাবেরই শামিল হয়, তবে সেটা এইরকম যুদ্ধই হত । বাস্তবের সঙ্গে এই অনৈক্য নিয়ে যাদের মনে অশ্রদ্ধা বা কৌতুক জন্মায় শেকসপিয়রের নাটক পড়েও তাদের হাসা উচিত- কেননা, তাতে লড়তে লড়তেও ছন্দ, মরতে মরতেও তাই । সিনেমাতে আছে রূপের সঙ্গে গতি, সেই সুযোগটিকে যথার্থ আর্টে পরিণত করতে গেলে আখ্যানকে নাচে দাড়-করানো চলে । বলা বাহুল্য, বাইনাচ প্রভৃতি যে-সব পদার্থকে আমরা নাচ বলি তার আদর্শ এ নাচের নয়। জাপানে কিয়োটোতে ঐতিহাসিক নাট্যের অভিনয় দেখেছি ; তাতে কথা আছে বটে ; কিন্তু তার ভাবভঙ্গি চলাফেরা সমস্ত নাচের ধরনে ; বড়ো আশ্চর্য তার শক্তি । নাটকে আমরা যখন ছন্দোময় বাক্য ব্যবহার করি। তখন সেই সঙ্গে চলাফেরা হাবভাব যদি সহজ রকমেরই রেখে দেওয়া হয় তা হলে সেটা অসংগত হয়ে ওঠে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই । নামেতেই প্ৰকাশ পায়, আমাদের দেশে একদিন নাট্য অভিনয়ে সর্বপ্রধান অঙ্গই ছিল নাচ । নাটক দেখতে যারা আসে, পশ্চিম মহাদেশে তাদের বলে অডিয়েনস, অর্থাৎ শ্রোতা । কিন্তু, ভারতবর্ষে নাটককে বলেছে দৃশ্যকাব্য ; অর্থাৎ তাতে কাব্যকে আশ্রয় করে চোখে দেখার রস দেবার জন্যেই অভিনয় । এই তো গেল নাচের দ্বারা অভিনয় । কিন্তু বিশুদ্ধ নাচও আছে। পরশু রাত্রে সেটা গিয়ানয়ারের রাজবাড়িতে দেখা গেল । সুন্দর-সাজ-করা দুটি ছোটাে মেয়ে- মাথায় মুকুটের উপর ফুলের দণ্ডগুলি একটু নড়াতেই দুলে ওঠে । গামেলান বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে দুজনে মিলে নাচতে লাগল। এই বাদ্যসংগীত আমাদের সঙ্গে ঠিক মেলে না । আমাদের দেশের জলতরঙ্গ বাজনা আমার কাছে সংগীতের ছেলেখেলা বলে ঠেকে । কিন্তু, সেই জিনিসটিকে গভীর, প্রশস্ত, সুনিপুণ বহুযন্ত্রমিশ্রিত বিচিত্র আকারে এদের বাদ্যসংগীতে যেন পাওয়া যায়। রাগরাগিণীতে আমাদের সঙ্গে কিছুই মেলে না ; যে-অংশে মেলে সে হচ্ছে এদের মৃন্দঙ্গের ধ্বনি, সঙ্গে করতালও আছে। ছোটাে বড়ো ঘণ্টা এদের এই সংগীতের প্রধান অংশ । আমাদের দেশের নাট্যশালায় কন্সার্ট বাজনার যে নূতন রীতি হয়েছে। এ সেরকম নয় ; অথচ, য়ুরোপীয় সংগীতে বহু যন্ত্রের যে-হার্মনি এ তাও নয় । ঘণ্টার মতো শব্দে একটা মূল স্বরসমাবেশ কানে আসছে ; তার সঙ্গে নানাপ্রকার যন্ত্রের নানারকম আওয়াজ যেন একটা কারুশিল্পে গাথা হয়ে উঠছে। সমস্তটাই যদিও আমাদের থেকে একেবারেই স্বতন্ত্র, তবু শুনতে ভারি মিষ্টি লাগে । এই ংগীত পছন্দ করতে যুরোপীয়দেরও বাধে না । গামেলান বাজনার সঙ্গে ছোটাে মেয়ে দুটি নাচলে ; তার শ্ৰী অত্যন্ত মনোহর। অঙ্গে-প্রত্যঙ্গে সমস্ত শরীরে ছন্দের যে-আলোড়ন তার কী চারুতা, কী বৈচিত্ৰ্য, কী সীেকুমাৰ্য, কী সহজ লীলা । অন্য নাচে দেখা যায়, নটী তার দেহকে চালনা করছে ; এদের দেখে মনে হতে লাগল, দুটি দেহ যেন স্বত-উৎসারিত নাচের ফোয়ারা । বারো বছরের পরে এই মেয়েদের আর নাচতে দেওয়া হয় না ; বারো বছরের পরে শরীরের এমন সহজ সুকুমার হিল্লোল থাকা সম্ভব নয় ।