পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Gł Rbr রবীন্দ্র-রচনাবলী সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হয়েও এত শতাব্দী পরেও ভারতবর্ষের এত জিনিস যে এখানে এখনো এমন করে আছে, তার কারণ, এটা দ্বীপ ; এখানে সহজে কোনো জিনিস ভ্ৰষ্ট হয়ে যেতে পারে না । অর্থ নষ্ট হতে পারে, একটার দ্বারা আর-একটা চাপা পড়তে পারে, কিন্তু বস্তুটা তবু থেকে যায় । এই কারণেই প্ৰাচীন ভারতের অনেক জিনিসই এখানে আমরা বিশুদ্ধভাবে পাব বলে আশা করি। হয়তো এখানকার নাচ এবং নৃত্যমূলক অভিনয়টা সেই জাতের হতেও পারে। এখানকার রাজাদের বলে ‘আর্য । আমার বিশ্বাস, তার অর্থ, রাজবংশ নিজেদের আর্যবংশীয় বলেই জানে, তারা স্থানীয় অধিবাসীদের স্বজাতীয় ছিল না । তাই, এখানকার রাজাদের ঘরে যে-সকল কলা ও অনুষ্ঠান আজও চলে আসছে সেগুলি সন্ধান করলে এমন অনেক জিনিস পাওয়া যাবে যা আমাদের দেশে লুপ্ত ও বিস্মৃত । এই ছোটো দ্বীপে এককালে অনেক রাজা ছিল, তাদের কেউ-কেউ ওলন্দাজ-আক্রমণে আসন্নপরাভাবের আশঙ্কায় দলে দলে হাজার হাজার লোক নিঃশেষে আত্মহত্যা করে মরেছে । এখনো রাজোপাধিধারী যে কয়েকজন আছে তারা পুরোনো দামী শামাদানের মতো, যাতে বাতি আর জ্বলে না । তাদের প্রাসাদ ও সাজসজা আছে, তা ছাড়া তারা যেখানে আছে তাকে নগর বলা চলে । কিন্তু, এই নগরে। আর গ্রামে যে পার্থক্য সে যেন ভাইবোনের পার্থক্যের মতো- তারা এক বাড়িতেই থাকে, তাদের মাঝে প্রাচীর নেই । আধুনিক ভারতে শিল্পচর্চা প্রভৃতি নানা বিষয়ে নগরে গ্রামে ছাড়াছাড়ি । শহরগুলি যে দীপ জ্বলে তার আলো গ্রামে গিয়ে পড়েই না । দেশের সম্পত্তি যেন ভাগ হয়ে গেছে, গ্রামের অংশে যেটুকু পড়েছে তাতে আচার অনুষ্ঠান বজায় রাখা সম্ভব নয় । এই কারণে সমস্ত দেশ এক হয়ে কোনো শিল্প, কোনো বিদ্যাকে রক্ষণ ও পোষণ করতে পারে না । তাই শহরের লোক যখন দেশের কথা ভাবে তখন শহরকেই দেশ বলে জানে ; গ্রামের লোক দেশের কথা ভাবতেই জানে না। এই বালিতে আমরা মোটরে মোটরে দূরে দূরান্তরে যতই ভ্ৰমণ করি।- নদী, গিরি, বন, শস্যক্ষেত্র ও পল্লীতে-শহরে মিলে খুব একটা ঘনিষ্ঠতা দেখতে পাই ; এখানকার সকল মানুষের মধ্যেই যেন এদের সকল সম্পদ ছড়ানো । গামেলান-সংগীতের কথা পর্বেই বলেছি। ইতিমধ্যে এ সম্বন্ধে আমাকে চিন্তা করতে হয়েছে। এরা- যে আপনমনে সহজ আনন্দে গান গায় না, তার কারণ এদের কণ্ঠসংগীতের অভাব । এরা টিংটিং টুং টাং করে যে-বাজনা বাজায় বস্তুত তাতে গান নেই, আছে তাল । নানা যন্ত্রে এরা তালেরই বোল দিয়ে চলে । এই বোল দেবার কোনো কোনো যন্ত্র ঢাক-ঢোলের মতোই, তাতে স্বর অল্প, শব্দই বেশি ; কোনো কোনো যন্ত্র ধাতুতে তৈরি, সেগুলি স্বরবান । এই ধাতু যন্ত্রে টানা সুর থাকা সম্ভব নয়, থাকবার দরকার নেই, কেননা টানা সুর গানেরই জন্যে, বিচ্ছিন্ন সুরগুলিতে তালেরই বোল দেয় । আসলে এরা গান গায় গলা দিয়ে নয়, সর্বাঙ্গ দিয়ে ; এদের নাচই যেন পদে পদে টানা সুরের মিড় দেওয়া- বিলিতি নাচের মতো ঝম্পবহুল নয়। অর্থাৎ এদের নােচ বর্ষার ঝমােঝম জলবিন্দুবৃষ্টির মতো নয়, ঝরনার তরঙ্গিত ধারার মতো । তাল যে ঐক্যকে দেখায় সে হচ্ছে কালের অংশগুলিকে যোজনা করে, গান যে-ঐক্যকে দেখায় সে হচ্ছে রসের অখণ্ডতাকে সম্পূৰ্ণ করে । তাই বলছি, এদের সংগীতই তাল, এদেরই নৃত্যই গান । আমাদের দেশে এবং য়ুরোপে গীতাভিনয় আছে, এদের দেশে নৃত্যাভিনয় । ইতিমধ্যে এখানকার ওলন্দাজ রাজপুরুষ অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। এদের একটা বিশেষত্ব আমার চোখে লাগল। অধীনস্থ জাতের উপর এদের প্রভুত্ব যথেষ্ট নেই, তা নয়, কিন্তু এদের ব্যক্তিগত ব্যবহারে কর্তৃত্বের ঔদ্ধত্য লক্ষ্য করি নি। এখানকার লোকদের সঙ্গে এরা সহজে মেলামেশা করতে পারে । দুই জাতির পরস্পরের মধ্যে বিবাহ সর্বদাই হয় এবং সেই বিবাহের সন্তানেরা পিতৃকুল থেকে ভ্ৰষ্ট হয় না । এখানে অনেক উচ্চপদের ওলন্দাজ আছে যারা সংকর বর্ণ ; তারা অবজ্ঞাভাজন নয় । এখানকার মানুষকে মানুষ জ্ঞান করে এমন সহজ ব্যবহার কেমন করে সম্ভব হল, এই প্রশ্ন করাতে একজন ওলন্দাজ আমাকে বলেছিলেন, “যাদের অনেক সৈন্য, অনেক যুদ্ধজাহাজ, অনেক সম্পদ, অনেক সাম্রাজ্য, ভিতরে ভিতরে সর্বদাই তাদের মনে থাকে যে তারা একটা মন্ত-কিছু ; এইজন্য ছোটাে দরজা দিয়ে ঢুকতে তাদের অত্যন্ত বেশি সংকুচিত হতে হয় । নিজেদের সর্বদা তত প্রকাও