পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী GłVOS সুসম্পূর্ণভাবে ইচ্ছা করি নিজের দেশে। কিন্তু, এই ছােটাে দ্বীপের রাস্তার ধারে যে-ব্যাপারটিকে দেখা গেল সে কি সহজ কথা । কত কালের সাধনায়, ভিতরের কত গ্ৰন্থি মোচন করে তবে এইটকু জিনিস সহজ হয় । জড়ো হওয়া শক্ত নয়, এক হওয়াই শক্ত । সেই ঐক্যকে সকলের সৃষ্টিশক্তি দ্বারা, ত্যাগের দ্বারা, সুন্দর করে তোলা কতই শক্তিসাধ্য। আমাদের মিলিত কাজকে সকলে এক হয়ে উৎসবের রূপ দেওয়া আবশ্যক । আনন্দকে সুন্দরকে নানা মূর্তিতে নানা উপলক্ষে প্ৰকাশ করা চাই । সেই প্রকাশে সকলেই আপনি-আপিন ইচ্ছার, আপনি-আপিন শক্তির, যোগদান করতে থাকলে তবেই আমাদের ভিতরকার খোচাগুলো ক্ৰমে ক্ৰমে ক্ষয় হয়ে যায়, ঝরনার জল ক্ৰমাগত বইতে থাকলে তলার নুড়িগুলি যেমন সুডোল হয়ে আসে। আমাদের অনেক তপস্বী মনে করেন, সাধনায় জ্ঞান ও কর্মই যথেষ্ট । কিন্তু, বিধাতার রচনায় তিনি দেখিয়েছেন শুধু স্বাভাবিকী জ্ঞানবিলক্রিয়া নয়, ব্লসেই সৃষ্টির চরম সম্পূর্ণতা । মরুর মধ্যে যা-কিছু শক্তি সমস্তই বিরোধের শক্তি, বিনাশের শক্তি । রস যখন সেখানে আসে তখনই প্ৰাণ আসে ; তখন সব শক্তি সেই রসের টানে ফুল ফোটায়, ফল ধরায় ; সৌন্দর্যে কল্যাণে সে উৎসবের রূপ ধারণ করে । বেলা আটটা বাজল । বারান্দার সামনে গোটা-দুই-তিন মোটরগাড়ি জমা হয়েছে। সুরেনে সুনীতিতে মিলে নানা আয়তনের বাক্সে ব্যাগে বুলিতে থলিতে গাড়ি বোঝাই করছেন । তারা একদল আগে থাকতেই খেয়াঘাটের দিকে রওনা হবার অভিমুখী । নিকটের পাহাড়ের ঘনসবুজ অরণ্যের পরে রৌদ্র পড়েছে ; দূরের পাহাড় নীলাভ বাম্পে আবৃত । দক্ষিণ শৈলীতটের সমুদ্রখণ্ডটি নিশ্বাসের-ভাপ-লাগা আয়নার মতো স্নান । ঐ কাছেই গিরিবক্ষসংলগ্ন পল্লীটির বনবেষ্টনের মধ্যে সুপুরিগাছের শাখাগুলি শীতের বাতাসে দুলছে । ঝরনা থেকে মেয়েরা জলপাত্রে জল বয়ে আনছে। নীচে উপত্যকায় শস্যক্ষেত্রের ওপারে, সামনের পাহাড়ের গায়ে ঘন গাছের অবকাশে লোকালয়ের আভাস দেখা যায়। নারকেলগাছগুলি মেঘমুক্ত আকাশের দিকে পাতার অঞ্জলি তুলে ধরে সূর্যালোক পান করছে । এখান থেকে বিদায় নেবার মুহুর্তে মনে মনে ভাবছি, দ্বীপটি সুন্দর, এখানকার লোকগুলিও ভালো, তবুও মন এখানে বাসা বাধতে চায় না । সাগর পার হয়ে ভারতবর্কের আহবান মনে এসে পৌঁচাচ্ছে । শিশুকাল থেকে ভারতবর্কের ভিতর দিয়েই বিশ্বের পরিচয় পেয়েছি বলেই যে এমন হয় তা নয় ; চিরদিনের মতো আমার মন তাতে ভুলেছে। সেখানে বেদনা অনেক পাই, লোকালয়ে দুৰ্গতির মূর্তি চারি দিকে ; তবুও সমস্তকে অতিক্রম করে সেখানকার আকাশে অনাদি কালের যে-কণ্ঠ ধ্বনি শুনতে পাই তাতে একটি বৃহৎ মুক্তির আস্বাদ আছে । ভারতবর্ষের নীচের দিকে ক্ষুদ্রতার বন্ধন, তুচ্ছতার কোলাহল, হীনতার বিড়ম্বনা, যত বেশি এমন আর কোথাও দেখি নি ; তেমনি উপরের দিকে সেখানে বিরাটের আসনবেদী, অপরিসীমের অবারিত আমন্ত্রণ । অতি দূরকালের তপোবনের ওঙ্কারধ্বনি এখনো সেখানকার আকাশে যেন নিত্য-নিশ্বাসিত । তাই, আমার মনের কাছে আজকের এই প্ৰশান্ত প্ৰভাত সেই দিকেই তার আলোকের ইঙ্গিত প্রসারিত করে রয়েছে । ইতি ৮ই স্বেপ্টেম্বর ১৯২৭ পুনশ্চঃ দ্ৰুত চলতে চলতে উপরে উপরে যে-ছবি চোখে জাগল, যে-ভাব মনের উপর দিয়ে ভেসে গেল, তাই লিখে দিয়েছি, কিন্তু তাই বলে এটাকে বালির প্রকৃত বিবরণ বলে গণ্য করা চলবে না। এই নিত্যই পড়ে তো । অতএব, আবরণটিকে মানুষের পরিচয় নয় বলে উপেক্ষা করা যায় না । যে-আবরণ কৃত্রিম ছদ্মবেশের মতো সত্যকে উপর থেকে চাপা দেয়। সেইটোতেই প্রতারণা করে, কিন্তু যে-আবরণ চঞ্চল জীবনের প্রতি মুহুর্তের ওঠায়-পড়ায়, বাকায়-চোরায়, দোলায়-কঁপিনে, আপোনা-আপনি একটা চেহারা পায় মোটের উপর তাকে বিশ্বাস করা চলে । এখানকার ঘরে মন্দিরে,