পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

- যাত্রী ( S) Գ নাচ, সে বড়ো আশ্চর্য । তাতে যেমন পৌরুষ সৌন্দৰ্য্যও তেমনি । লড়াইয়ের দ্বন্দ্ব-অভিনয়ে নাচের প্রকৃতি একটুমাত্র এলোমেলো হয়ে যায় নি । আমাদের দেশের স্টেজে রাজপুত বীরপুরুষের বীরত্ব যেরকম নিতান্ত খেলো এ তা একেবারেই নয়। প্রত্যেক ভঙ্গিতে ভারি একটা মৰ্যাদা আছে । গদাযুদ্ধ, মল্লযুদ্ধ, মূষলের আঘাত, সমস্তই ত্রুটিমাত্রবিহীন নাচে ফুটে উঠেছে । সমস্তর মধ্যে অপূর্ব একটি শ্ৰী অথচ দৃপ্ত পৌরুষের আলোড়ন । এর আগে এখানে মেয়েদের নােচ দেখেছি, দেখে মুগ্ধও হয়েছি, কিন্তু এই পুরুষের নাচের তুলনায় তাকে ক্ষীণ বােধ হল । এর স্বাদ তার চেয়ে অনেক বেশি প্রবল। যখন ধ্ৰুপদের নেশায় পেয়ে বসে তখন টপ্পার নিছক মিষ্টতা হালকা বােধ হয় এও সেইরকম । আজ সকালে দশটার সময়ে আমাদের এখানেই গৃহকর্তা আর-একটি নাচের ব্যবস্থা করেছিলেন । কিন্তু আমার তো মনে পড়ল না । ব্যাপারটা হচ্ছে- কোন-এক বাগানে অর্জনের অস্ত্র ছিল, সেই অস্ত্র চুরি করেছে সুবল, সে খুঁজে বেড়াচ্ছে অর্জনকে মারবার জন্যে। অর্জন ছিল বাগানের মালী-বেশে । খানিকটা কথাবার্তার পরে দুজনের লড়াই । সুবলের কাছে বলরামের লাঙল অস্ত্রটা ছিল । যুদ্ধ করতে নটীরা যে মেয়ে সেটা বুঝতে কিছুই বাধে না, অতিরিক্ত যত্নে সেটা লুকোবার চেষ্টাও করে নি । তার কারণ, যারা নাচছে তারা মেয়ে কি পুরুষ সেটা গৌণ, নাচটা কী সেইটেই দেখবার বিষয় । দেহটা মেয়ের কিন্তু লড়াইটা পুরুষের, এর মধ্যে একটা বিরুদ্ধতা আছে বলেই এই অদ্ভুত সমাবেশে বিষয়টা আরো যেন তীব্র হয়ে ওঠে । কমনীয়তার আধারে বীররসের উচ্ছলতা । মনে করো না— বাঘ নয়, সিংহ নয়, জবাফুলে ধুতরাফুলে সাংঘাতিক হানাহানি, ডাটায় ডাটায় সংঘর্ষ, পাপড়িগুলি ছিন্নবিচ্ছিন্ন : এদিকে বনসভা কঁাপিয়ে বৈশাখী ঝড়ের গামেলান বাজছে, গুরুগুরু মেঘের মৃদঙ্গ, গাছের ডালে ডালে ঠিকাঠিকি, আর সো সো শব্দে বাতাসের বাশি । সব-শেষে এলেন রাজার ভাই । এবার তিনি একলা নাচলেন । তিনি ঘটোৎকচ । হাস্যরসিক বাঙালি হয়তো ঘটোৎকচকে নিয়ে বরাবর হাসাহসি করে এসেছে । এখানকার লোকচিত্তে ঘটােৎকচের খুব আদর । সেইজন্যেই মহাভারতের গল্প এদের হাতে আরো অনেকখানি বেড়ে গেল । এরা ঘটােৎকচের সঙ্গে ভাগিব (ভাগবী) বলে এক মেয়ের ঘটালে বিয়ে । সে মেয়েটি আবার অর্জনের কন্যা । বিবাহ সম্বন্ধে এদের প্রথা যুরোপের কাছাকাছি যায় । খুড়তোত জাঠাতোত ভাইবোনে বাধা নেই । ভাগিাবার গর্ভে ঘটোৎকচের একটি ছেলেও আছে, তার নাম শশিকিরণ । যা হোক, আজকের নাচের বিষয়টা হচ্ছে, প্ৰিয়তমাকে স্মরণ করে বিরহী ঘটােৎকচের ঔৎসুক্য । এমন-কি, মাঝে মাঝে মুছার ভাবে সে মাটিতে বসে পড়ছে, কল্পনায় আকাশে তার ছবি দেখে সে ব্যাকুল । অবশেষে আর থাকতে না পেরে প্রেয়সীকে খুঁজতে সে উড়ে চলে গেল। এর মধ্যে একটি ভাববার জিনিস আছে। যুরোপীয় শিল্পীর এঞ্জেলদের মতো এরা ঘটোৎকচের পিঠে নকল পাখা বসিয়ে দেয় নি । চাদরখানা নিয়ে নাচের ভঙ্গিতে ওড়ার ভাব দেখিয়েছে। এর থেকে মনে পড়ে গেল শকুন্তলা নাটকে কবির নির্দেশবাক্য- রথবেগং নাটয়তি । বোঝা যাচ্ছে, রথবেগটা নাচের দ্বারাই প্ৰকাশ হত, রথের দ্বারা নয় । রামায়ণের মহাভারতের গল্প এ দেশের লোকের মনকে জীবনকে যে কিরকম গভীরভাবে অধিকার করেছে তা এই কদিনেই স্পষ্ট বোঝা গেল । ভূগোলের বইয়ে পড়া গেছে, বিদেশ থেকে অনুকূল ক্ষেত্রে কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদের নতুন আমদানি হবার অনতিকাল পরেই দেখতে দেখতে তারা সমস্ত দেশকে হেয়ে ফেলেছে ; এমন-কি, যেখান থেকে তাদের আনা হয়েছে সেখানেও তাদের এমন অপরিমিত প্রভাব নেই। রামায়ণ-মহাভারতের গল্প এদের চিত্তক্ষেত্রে তেমনি করে এসে তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। চিত্তের এমন প্রবল উদবােধন কলারচনায় নিজেকে প্রকাশ না করে থাকতে পারে না । সেই প্রকাশের অপর্যাপ্ত আনন্দ দেখা দিয়েছিল বরোবুন্দরের মূর্তিকল্পনায় । আজ এখানকার মেয়েপুরুষ নিজেদের দেহের মধ্যেই যেন মহাকাব্যের পাত্রদের চরিতকথাকে নৃত্যমূর্তিতে প্রকাশ করছে ; ছন্দে