পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○○br রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ছন্দে এদের রক্তপ্রবাহে সেই- সকল কাহিনী ভাবের বেগে আন্দোলিত । এ ছাড়া কত রকম-বেরকমের অভিনয়, তার অধিকাংশই এই সকল বিষয় নিয়ে । বাইরের দিকে ভারতবর্ষের থেকে এরা বহু শতাব্দী সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ; তবু এতকাল এই রামায়ণ মহাভারত নিবিড়ভাবে ভারতবর্ষের মধ্যেই এদের রক্ষা করে এসেছে । ওলন্দাজরা এই দ্বীপগুলিকে বলে “ডাচ ইউীস’, বস্তুত এদের বলা যেতে পারে ‘ব্যাস ইভীস’ । পূর্বেই বলেছি, এরা ঘটােৎকচের ছেলের নাম রেখেছে। শশিকিরণ । সংস্কৃত ভাষা থেকে নাম রচনা এদের আজও চলেছে। মাঝে মাঝে নামকরণ অদ্ভুতরকম হয় । এখানকার রাজবৈদ্যের উপাধি ক্রীড়নির্মল । আমরা যাকে নিরাময় বা নীরোগ বলে থাকি এরা নির্মল শব্দকে সেই অর্থ দিয়েছে । এদিকে ক্রীড় শব্দ আমাদের অভিধানে খেলা, কিন্তু ক্রীড় বলতে এখানে বোঝাচ্ছে উদ্যোগ । রোগ দূর করাতেই যার উদ্যোগ সেই হল ক্রীড়নির্মল । ফসলের খেতে যে সেচ দেওয়া হয় তাকে এরা বলে সিন্ধু-অমৃত । এখানে জল অর্থেই সিন্ধু কথার ব্যবহার, ক্ষেত্ৰকে যো-জলসেচ মৃত্যু থেকে বাচায় সেই হল সিন্ধু-অমৃত । আমাদের গৃহস্বামীর একটি ছেলের নাম সরোষ, আর-একটির নাম সন্তোষ । বলা বাহুল্য, সরোষ বলতে এখানে রাগী মেজাজের লোক বোঝায় না, বুঝতে হবে সতেজ । রাজার মেয়েটির নাম কুসুমবাধিনী । অনন্তকুসুম, জাতিকুসুম, কুসুমায়ুধ, কুসুমব্রত, এমন সব নামও শোনা যায় । এদের নামে যেমন বিশুদ্ধ ও সুগভীর সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার এমনতরো আমাদের দেশে দেখা যায় না । যেমন আত্মসূবিজ্ঞ, শাস্ত্রাত্ম, বীর্যপুস্তক, বীর্যসুশাস্ত্ৰ, সহস্রপ্রবীর, বীর্যসুব্রত, পদ্মসুশাস্ত্ৰ, কৃতাধিরাজ, সহস্ৰ সুগন্ধ, পূৰ্ণপ্ৰণত, যশোবিদগ্ধ, চক্ৰাধিরাজ, মৃতসঞ্জয়, আৰ্যসুতীর্থ, কৃতস্মর, চক্ৰাধিব্রত, সূর্যপ্ৰণত, কৃতবিভব । সেদিন যে-রাজার বাড়িতে গিয়েছিলেম তার নাম সুসুহুনান পাকু-ভুবন । তারই এক ছেলের বাড়িতে কাল আমাদের নিমন্ত্রণ ছিল, তার নাম অভিমন্য । এদের সকলেরই সৌজন্য স্বাভাবিক, নম্রতা সুন্দর । সেখানে মহাভারতের বিরাটপর্ব থেকে ছায়াভিনয়ের পালা চলছিল । ছায়াভিনয় এ দেশ ছাড়া আর কোথাও দেখি নি, অতএব বুঝিয়ে বলা দরকার । একটা সাদা কাপড়ের পট টাঙানো, তার সামনে একটা মস্ত প্ৰদীপ উজ্জ্বল শিখা নিয়ে জ্বলছে ; তার দুই ধারে পাতলা চামড়ায় আঁকা মহাভারতের নানা চরিত্রের ছবি সাজানো, তাদের হাতপাগুলো দড়ির টানে নড়ানো যায় এমনভাবে গাথা । এই ছবিগুলি এক-একটা লম্বা কাঠিতে বাধা । একজন সুর করে গল্পটা আউড়ে যায়, আর সেই গল্প-অনুসারে ছবিগুলিকে পটের উপরে নানা ভঙ্গিতে নাড়াতে দোলাতে চালাতে থাকে । ভাবের সঙ্গে সংগতি রেখে গামেলান বাজে । এ যেন মহাভারতশিক্ষার একটা ক্লাসে পাঠের সঙ্গে ছবির অভিনয়-যোগে বিষয়টা মনে মুদ্রিত করে দেওয়া । মনে করো, এমনি করে যদি স্কুলে ইতিহাস শেখানো যায়, মাস্টারমশায় গল্পটা বলে যান আর একজন পুতুল-খেলাওয়ালা প্ৰধান প্রধান ব্যাপারগুলো পুতুলের অভিনয় দিয়ে এমন সুন্দর উপায় কী আর হতে পারে। মানুষের জীবন বিপদসম্পদ-সুখদুঃখের আবেগে নানাপ্রকার রূপে ধ্বনিতে স্পর্শে লীলায়িত হয়ে চলছে ; তার সমস্তটা যদি কেবল ধবনিতে প্ৰকাশ করতে হয় তা হলে সে একটা বিচিত্ৰ সংগীত হয়ে ওঠে ; তেমনি আর-সমস্ত ছেড়ে দিয়ে সেটাকে কেবলমাত্র যদি গতি দিয়ে প্ৰকাশ করতে হয় তা হলে সেটা হয় নাচ । ছন্দোময় সুরই হােক আর নৃত্যই হােক, তার একটা গতিবেগ আছে, সেই বেগ আমাদের চৈতন্যে রস চাঞ্চল্য সঞ্চার করে তাকে প্রবলভাবে জাগিয়ে রাখে । কোনো ব্যাপারকে নিবিড় করে উপলব্ধি করাতে হলে আমাদের চৈতন্যকে এইরকম বেগবান করে তুলতে হয় । এই দেশের লোক ক্রমাগতই সুর ও নাচের সাহায্যে রামায়ণ মহাভারতের গল্পগুলিকে নিজের চৈতন্যের মধ্যে সর্বদাই দোলায়িত করে রেখেছে । এই কাহিনীগুলি রসের ঝরনাধারায় কেবলই এদের জীবনের উপর দিয়ে প্রবাহিত । রামায়ণ-মহাভারতকে এমনি নানাবিধ প্ৰাণবান উপায়ে সর্বতোভাবে আত্মসাৎ করবার চেষ্টা । শিক্ষার বিষয়কে একান্ত করে গ্রহণ ও ধারণ করবার প্রকৃষ্ট প্ৰণালী কী তা যেন সমস্ত দেশের