পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী ○ ご)。 লোকে মিলে উদ্ভাবন করেছে ; রামায়ণ-মহাভারতকে গভীর করে পাবার আগ্রহে ও আনন্দেই এই উদ্ভাবনা স্বাভাবিক হল । কাল যে ছবির অভিনয় দেখা গেল তাও প্রধানতই নাচ, অর্থাৎ ছন্দোময় গতির ভাষা দিয়ে গল্প-বলা । এর থেকে একটা কথা বোঝা যাবে। এ দেশে নাচের মনোহারিতা ভোগ করবার জন্যেই নাচ নয় ; নাচটা এদের ভাষা । এদের পুরাণ ইতিহাস নাচের ভাষাতেই কথা কইতে থাকে । এদের গামেলানের সংগীতটাও সুরের নাচ । কখনো দ্রুত, কখনো বিলম্বিত, কখনো প্ৰবল, কখনো মৃদু, এই সংগীতটাও সংগীতের জন্যে নয়, কোনো-একটা কাহিনীকে নৃত্যচ্ছন্দের অনুষঙ্গ দেবার জন্যে । দীপালোকিত সভায় এসে যখন প্রথম বসলুম তখন ব্যাপারখানা দেখে কিছুই বুঝতে পারা গোল না । বিরক্ত বোধ হতে লাগল। খানিক বাদে আমাকে পটের পশ্চাৎভাগে নিয়ে গেল। সেদিকে আলো নেই, সেই অন্ধকার ঘরে মেয়েরা বসে দেখছে। এদিকটাতে ছবিগুলি অদৃশ্য, ছবিগুলিকে যে-মানুষ। নাচাচ্ছে তাকেও দেখা যায় না, কেবল আলোকিত পটের উপর অন্য পিঠের ছবির ছায়াগুলি নোচে বেড়াচ্ছে। যেন উত্তানশায়ী শিবের বুকের উপরে মহামায়ার নাচ । জ্যোতিলোকে যে-সৃষ্টিকর্তা আছেন তিনি যখন নিজের সৃষ্টিপটের আড়ালে নিজেকে গোপন রাখেন তখন আমরা সৃষ্টিকে দেখতে পাই । সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সৃষ্টির অবিশ্রাম যোগ আছে বলে যে জানে সে-ই তাকে সত্য বলে জানে। সেই যোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে এই চঞ্চল ছায়াগুলোকে নিতান্তই মায়া বলে বোধ হয় । কোনো কোনো সাধক পটটাকে ছিড়ে ফেলে ওপারে গিয়ে দেখতে চায়, অর্থাৎ, সৃষ্টিকে বাদ-দিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে দেখবার চেষ্টা— কিন্তু তার মতো মায়া আর কিছুই হতে পারে না । ছায়ার খেলা দেখতে দেখতে এই কথাটাই কেবল আমার মনে হচ্ছিল । আমি যখন চলে আসছি আমাদের নিমন্ত্রণকর্তা আমাকে খুব একটি মূল্যবান উপহার দিলেন । বড়ো একটি বাটিক শিল্পের কাপড় । বললেন, এইরকমের বিশেষ কাপড় রাজবংশের ছেলেরা ছাড়া কেউ পরতে পায় না । সুতরাং, এ জাতের কাপড় আমি কোথাও কিনতে পেতুম না । আমাদের এখানকার পালা আজ শেষ হল । কাল যাব যোগ্যকর্তায় । সেখানকার রাজবাড়িতেও নাচগান প্ৰভৃতির রীতিপদ্ধতি বিশুদ্ধ প্ৰাচীনকালের, অথচ এখানকার সঙ্গে পার্থক্য আছে । যোগ্যকর্তা থেকে বোরোবুন্দর কাছেই ; মোটরে ঘণ্টাখানেকের পথ । আরো দিন পাচ-ছয় লাগবে এই সমস্ত দেখে শুনে নিতে, তার পরে ছুটি । ইতি ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯২৭ * | 6 কল্যাণীয়েযু অমিয়, এখানকার দেখাশুনো প্ৰায় শেষ হয়ে এল । ভারতবর্ষের সঙ্গে জোড়াতাড়া দেওয়া এদের লোকযাত্রা দেখে পদে পদে বিস্ময় বোধ হয়েছে । রামায়ণ-মহাভারত এখানকার লোকের প্রাণের মধ্যে যে কিরকম প্ৰাণবান হয়ে রয়েছে সে-কথা পূর্বেই লিখেছি। প্ৰাণবান বলেই এ জিনিসটা কোনো লিখিত সাহিত্যের সম্পূর্ণ পুনরাবৃত্তি নয় । এখানকার মানুষের বহুকালের ভাবনা ও কল্পনার ভিতর দিয়ে তার অনেক বদল হয়ে গেছে। তার প্রধান কারণ, মহাভারতকে এরা নিজেদের জীবনযাত্রার প্রয়োজনে প্রতিদিন ব্যবহার করেছে। সংসারের কর্তব্যনীতিকে এরা কোনো শাস্ত্ৰগত উপদেশের মধ্যে সঞ্চিত পায় নি, এই দুই মহাকাব্যের নানা চরিত্রের মধ্যে তারা যেন মূর্তিমান । ভালোমন্দ নানা শ্রেণীর মানুষকে বিচার করবার মাপকাঠি এই-সব চরিত্রে । এইজন্যেই জীবনের গতিবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের এই জীবনের সামগ্ৰীীর অনেকরকম বদল হয়েছে। কালে কালে বাঙালি গায়কের মুখে মুখে বিদ্যাপতি-চণ্ডিদাসের পদগুলি যেমন রূপান্তরিত হয়েছে এও তেমনি । কাল আমরা যে-ছায়াভিনয় s ਚਿਹਾ দেবীকে লিখিত । ७०||८१ }