পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী (? 8 (? এর আগে বােরোবুদুরের ছবি অনেকবার দেখেছি। তার গড়ন আমার চােখে কখনােই ভালো লাগে নি। আশা করেছিলুম হয়তো প্ৰত্যক্ষ দেখলে এর রস পাওয়া যাবে। কিন্তু, মন প্ৰসন্ন হল না । থাকে-থাকে একে এমন ভাগ করেছে, এর মাথার উপরকার চুড়াটুকু এর আয়তনের পক্ষে এমন ছোটাে যে, যত বড়োই এর আকার হােক এর মহিমা নেই। মনে হয়, যেন পাহাড়ের মাথার উপরে একটা পাথরের ঢাকনা চাপা দিয়েছে। এটা যেন কেবলমাত্র একটা আধারের মতো, বহুশত বুদ্ধমূর্তি ও বুদ্ধের জাতককথার ছবিগুলি বহন করবার জন্যে মস্ত একটি ডালি । সেই ডালি থেকে তুলে তুলে দেখলে অনেক ভালো জিনিস পাওয়া যায়। পাথরে-খোদা জাতকমূর্তিগুলি আমার ভারি ভালো লাগলপ্রতিদিনের প্রাণলীলার অজস্র প্রতিরূপ, অথচ তার মধ্যে ইতর অশোভন বা অশ্লীল কিছুমাত্র নেই। অন্য মন্দিরে দেখেছি সব দেবদেবীর মূর্তি, রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনীও খোদাই হয়েছে। এই মন্দিরে দেখতে পাই সর্বজনকে- রাজা থেকে আরম্ভ করে ভিখারি পর্যন্ত । বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে জনসাধারণের প্রতি শ্রদ্ধা প্রবল হয়ে প্রকাশ পেয়েছে ; এর মধ্যে শুদ্ধ মানুষের নয়, অন্য জীবেরও যথেষ্ট স্থান আছে । জাতককাহিনীর মধ্যে খুব একটা মস্ত কথা আছে, তাতে বলেছে, যুগ যুগ ধরে বুদ্ধ সর্বসাধারণের মধ্য দিয়েই ক্রমশ প্ৰকাশিত ৷ প্ৰাণীজগতে নিত্যকাল ভালোমন্দর যে দ্বন্দ্ব চলেছে সেই দ্বন্দ্বের প্রবাহ ধরেই ধর্মের শ্রেষ্ঠ আদর্শ বুদ্ধের মধ্যে অভিব্যক্ত । অতি সামান্য জন্তুর ভিতরেও অতি সামান্য রূপেই এই ভালোর শক্তি মন্দর ভিতর দিয়ে নিজেকে ফুটিয়ে তুলছে ; তার চরম বিকাশ হচ্ছে অপরিমেয় মৈত্রীর শক্তিতে আত্মত্যাগ । জীবে জীবে লোকে লোকে সেই অসীম মৈত্রী অল্প অল্প করে। নানা দিক থেকে আপন গ্ৰন্থি মোচন করছে, সেই দিকেই মোক্ষের গতি । জীব মুক্ত নয় কেননা, আপনার দিকেই তার টান ; সমস্ত প্ৰাণীকে নিয়ে ধর্মের যে অভিব্যক্তি তার প্রণালীপরম্পরায় সেই আপনার দিকে টানের 'পরে আঘাত লাগছে । সেই আঘাত যো-পরিমাণে যেখানেই দেখা যায়। সেই পরিমাণে সেখানেই বুদ্ধের প্রকাশ । মনে আছে, ছেলেবেলায় দেখেছিলুম, দড়িতে বাধা ধোপার বাড়ির গাধার কাছে এসে একটি গাভী স্নিগ্ধচক্ষে তার গা চেটে দিচ্ছে ; দেখে আমার বড়ো বিস্ময় লেগেছিল । বুদ্ধই-যে তার কোনো এক জন্মে সেই গাভী হতে পারেন, এ কথা বলতে জাতককথা-লেখকের একটুও বাধত না কেননা, গাভীর এই মেহেরই শেষ গিয়ে পৌচেছে মুক্তির মধ্যে । জাতককথায় অসংখ্য সামান্যের মধ্যে দিয়েই চরম অসামান্যকে স্বীকার করেছে । এতেই সামান্য এত বড়ো হয়ে উঠল । সেইজন্যেই এতবড়ো মন্দিরভিত্তির গায়ে গায়ে তুচ্ছ জীবনের বিবরণ এমন সরল ও নির্মল শ্রদ্ধার সঙ্গে চিত্রিত । ধর্মেরই প্ৰকাশচেষ্টার আলোতে সমস্ত প্ৰাণীর ইতিহাস বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে মহিমান্বিত । দুজন ওলন্দাজ পণ্ডিত সমস্ত ভালো করে ব্যাখ্যা করবার জন্যে আমাদের সঙ্গে ছিলেন । তাদের চরিত্রে পাণ্ডিত্যের সঙ্গে সরল হৃদ্যতার সম্মিলন আমার কাছে বড়ো ভালো লাগল। সব চেয়ে শ্রদ্ধা হয় এদের নিষ্ঠা দেখে । বোবা পাথরগুলোর মুখ থেকে কথা বের করবার জন্যে সমস্ত আয়ু দিয়েছেন । ঐদের মধ্যে পাণ্ডিত্যের কৃপণতা লেশমাত্র নেই— অজস্র দাক্ষিণ্য । ভারতবর্ষের ইতিহাসকে সম্পূর্ণ করে জেনে নেবার জন্যে এঁদেরই শুরু বলে মেনে নিতে হবে । জ্ঞানের প্রতি বিশুদ্ধ নিষ্ঠা থেকেই ঐদের এই অধ্যবসায় । ভারতের বিদ্যা, ভারতের ইতিহাস, ঐদের নিকটের জিনিস নয়, অথচ এইটেই ঐদের সমস্ত জীবনের সাধনার জিনিস। আরো কয়েকজন পণ্ডিতকে দেখেছি ; তাদের মধ্যেও সহজ নম্রতা দেখে আমার মন আকৃষ্ট হয়েছে। ইতি । SV GPCG3 SARA” ১ মীরা দেবীকে লিখিত ।