পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী ( 8Գ নিচ্ছে। আমরা একান্তভাবে গৃহস্থ । তার মানে, আমরা প্ৰত্যেকে আপনি গার্হস্থ্যের অংশমাত্র, দায়িত্বের হাজার বন্ধনে বাধা । জীবিকাগত দায়িত্বের সঙ্গে অনুষ্ঠানগত দায়িত্ব বিজড়িত । ক্রিয়াকর্মের নিরর্থক বোঝা এত অসহ্য বেশি যে, অন্য সকল যথার্থ কর্ম তারই ভারে অচলপ্ৰায় । জাতকর্ম থেকে আরম্ভ করে শ্রাদ্ধ পর্যন্ত যে-সমস্ত কৃত্য ইহলোক পরলোক জুড়ে আমাদের স্কন্ধে চেপেছে তাদের নিয়ে নড়াচড়া অসম্ভব, আর তারা আমাদের শক্তিকে কেবলই শোষণ করে নিচ্ছে । এই সমস্ত ঘরের ছেলেরা পরের হাতে মার খেতে বাধ্য। এ কথাটা আমরা ভিতরে ভিতরে বুঝতে পারছি । এইজন্যে আমাদের নেতারা সন্ন্যাসের দিকে এতটা ঝোক দিয়েছেন । অথচ, তারা সনাতন ধর্মকেও ধ্রুব সত্য বলে ঘোষণা করেন । কিন্তু, আমাদের সনাতন ধর্ম গার্হস্থ্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত । সস্ত্রীকং ধর্মমাচরেৎ । আমাদের দেশে বিস্ত্রীক ধর্মের কোনো মানে নেই । র্যারা সনাতন ধর্মের দোহাই দেন না, তারা বলেন, ক্ষতি কী । কিন্তু, বহু যুগের সমাজব্যবস্থার পুরাতন ভিত্তি যদি-বা ভাঙা সহজ হয় তার জায়গায় নতুন ভিত্তি গড়বে কতদিনে । কর্তব্য-অকর্তব্য সম্বন্ধে প্ৰত্যেক সমাজ কতকগুলি নীতিকে সংস্কারগত করে নিয়েছে । তর্ক ক’রে বিচার করে, অল্প লোক সিধে থাকতে পারে- সংস্কারের জোরেই তারা সংসারের পথে চলে । এক সংস্কারের জায়গায় আর-এক সংস্কার গড়া “তো সোজা কথা নয় । আমাদের সমাজের সমস্ত সংস্কারই আমাদের বহুদায়গ্রস্থিল। গাৰ্হস্থ্যকে দৃঢ়প্ৰতিষ্ঠ রাখবার জন্যে । য়ুরোপীয়দের কাছ থেকে বিজ্ঞান শেখা সহজ কিন্তু তাদের সমাজের সংস্কারকে আপন করা সহজ নয়। আমাদের জাহাজে ছিলেন টিনখিনির এক কর্তা ; বললেন, ষোলো বৎসর এইখানেই লেগে আছেন । টিন ছাড়া এখানে আর কিছু নেই। তবু এইখানেই তার বাসা বাধা । বাটাভিয়াতে সিন্ধি বণিকেরা দোকান করেছেন । দু বছর অন্তর বাড়ি যাবার নিয়ম । জিজ্ঞাসা করলুম, স্ত্রীপুত্র নিয়ে এখানে বাসা বাধতে দোষ কী । বললেন, স্ত্রীকে নিয়ে এলে চলবে কেন, স্ত্রী-যে সমস্ত পরিবারের সঙ্গে বাধা, তাকে সরিয়ে আনতে গেলে সেখানে ভাঙন ধরে। বোধ করি রামায়ণের যুগে এ তর্ক ছিল না। টিনের কর্তা বালককাল কাটিয়েছেন সাশ্রম বিদ্যালয়ে, বয়ঃপ্রাপ্ত হতেই কাজের সন্ধানে ফিরেছেন, বিবাহ করবামাত্র নিজের শক্তির পরেই সম্পূর্ণ ভর দিয়ে বসেছেন । বাপের তবিলের উপরে তাগিদ নেই, মা-মাসি-পিসেমশায়ের জন্যেও মন খারাপ হয় না । সেইজন্যেই এই জনবিরল নির্বাসনেও টিনের খনি চলছে। সমস্ত পৃথিবী জুড়ে এরা ঘর বাধতে পারল তার কারণ, এরা ঘরছাড়া । তার পরে মঙ্গলগ্রহের দিকে দূরবীন তুলে-যে এরা রাতের পর রাত কাটিয়ে দিচ্ছে তারও কারণ, এদের জিজ্ঞাসাবৃত্তি ঘরছাড়া । সনাতন গৃহস্থেরা এদের সঙ্গে কেমন করে পারবে । তাদের প্রচণ্ড গতিবেগে এদের ঘরের খুঁটিগুলো পড়ছে ভেঙে ; কিছুতে বাধা দিতে পারছে না। যতক্ষণ চুপ করে আছি ততক্ষণ যত রাজ্যের অহেতুক বোঝা জমে জমে পর্বতপ্রমাণ হয়ে উঠলেও তেমন দুঃখ বোধ হয় না, এমন-কি, ঠেস দিয়ে আরাম পাওয়া যায় । কিন্তু, ঘাড়ে তুলে নিয়ে চলতে গেলেই মেরুদণ্ড বঁাকে । যারা সচল জাত, বোঝাই সম্বন্ধে তাদের কেবলই সূক্ষ্ম বিচার করতে হয়। কোনটা রাখবার, কোনটা ফেলবার, এ তর্ক তাদের প্রতি মুহুর্তের ; এতেই আবর্জনা দূর করবার বুদ্ধি পাকা হয় । কিন্তু, সনাতন গৃহস্থ চণ্ডীমণ্ডপে আসন পেতে বসে আছেন ; তাই তার পজিকা থেকে তিনশো পয়ষটি-দিন-ভরা মূঢ়তায় আজ পর্যন্ত কিছুই বাদ পড়ল না । এই সমান্ত রাব্বিশ যাদের অন্তরে বাহিরে কানায় কানায় ভরপুর, হঠাৎ কংগ্রেসের মাচার উপর থেকে তাদের পরে হুকুম এল, লঘুভার মানুষের সঙ্গে সমান পা ফেলে চলতে হবে, কেননা, দু-চার দিনের মধ্যেই স্বরাজ চাই। জবাব দেবার ভাষা তাদের মুখে নেই, কিন্তু তাদের পাজার । ভাঙা বুকের ব্যথায় এই মুক মিনতি থেকে যায়, “তাই চলাবার চেষ্টা করব, কিন্তু কর্তারা আমাদের বোঝা নামিয়ে দেন ।” তখন কর্তারা শিউরে উঠে বলেন, “সর্বনাশ, ও-যে সনাতন বোঝা ।” ইতি মায়ার জাহাজ Y TONKIS YRA ১ নির্মলকুমারী মহলানবিশকে লিখিত ।