পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(? と ○ রবীন্দ্র-রচনাবলী চলতেই পারে না । ক্ষমতাশালী যদি আপন শক্তিমদে উন্মত্ত হয়ে না থাকত তা হলে সব চেয়ে ভয় করত এই অসাম্যের বাড়াবাড়িকে— কারণ অসামঞ্জস্য মাত্রই বিশ্ববিধির বিরুদ্ধে । মস্কো থেকে যখন নিমন্ত্রণ এল তখনো বলশেভিকদের সম্বন্ধে আমার মনে স্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না । তাদের সম্বন্ধে ক্ৰমাগতই উলটো উলটো কথা শুনেছি । আমার মনে তাদের বিরুদ্ধে একটা খটক ছিল । কেননা গোড়ায় ওদের সাধনা ছিল জবরদস্তির সাধনা । কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করে দেখলুম, ওদের প্রতি বিরুদ্ধতা যুরোপে যেন অনেকটা ক্ষীণ হয়ে এসেছে । আমি রাশিয়াতে আসছি শুনে অনেক লোকেই আমাকে উৎসাহ দিয়েছে। এমন-কি, অনেক ইংরেজের মুখেও ওদের প্রশংস শুনেছি। অনেকে বলেছে, ওরা অতি আশ্চর্য একটা পরীক্ষায় প্ৰবৃত্ত । আবার অনেকে আমাকে ভয় দেখিয়েছে ; কিন্তু প্ৰধান ভয়ের বিষয়, আরামের অভাব ; বলেছে। আহারাদি সমস্তই এমন মোটারকম যে আমি তা সহ্য করতে পারব না । তা ছাড়া এমন কথাও অনেকে বলেছে, আমাকে যা এরা দেখাবে তার অধিকাংশই বানানো । এ কথা মানতেই হবে, আমার বয়সে আমার মতো শরীর নিয়ে রাশিয়ায় ভ্ৰমণ দুঃসাহসিকতা । কিন্তু পৃথিবীতে যেখানে সব চেয়ে বড়ে ঐতিহাসিক যজ্ঞের অনুষ্ঠান সেখানে নিমন্ত্রণ পেয়েও না। আসা আমার পক্ষে আমাৰ্জনীয় হত । তা ছাড়া আমার কানে সেই কোরীয় যুবকের কথাটা বাজছিল । মনে মনে ভাবছিলুম, ধনশক্তিতে দুৰ্জয় পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রাঙ্গণদ্বারে ঐ রাশিয়া আজ নির্ধনের শক্তিসাধনার আসন পেতেছে। সমস্ত পশ্চিম মহাদেশের ভূকুটিকুটিল কটাক্ষকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, এটা দেখবার জন্যে আমি যাব না তো কে যাবে । ওরা শক্তিশালীর শক্তিকে, ধনশালীর ধনকে বিপর্যস্ত করে দিতে চায়, তাতে আমরা ভয় করব কিসের, রাগই করব বা কেন । আমাদের শক্তিই বা কী, ধনই বা কত । আমরা তো জগতের নিরন্ন নিঃসহায়দের দলের । যদি কেউ বলে, দুর্বলের শক্তিকে উদবোধিত করবার জন্যেই তারা পণ করেছে, তা হলে আমরা কোন মুখে বলব যে, তোমাদের ছায়া মাড়াতে নেই। তারা হয়তো ভুল করতে পারে— তাদের প্রতিপক্ষেরাও যে ভুল করছে না তা নয় । কিন্তু আমাদের বলবার আজ সময় এসেছে যে, অশক্তের শক্তি এখনই যদি না জাগে তা হলে মানুষের পরিত্রাণ নেই, কারণ শক্তিমানের শক্তিশেল অতিমাত্র প্রবল হয়ে উঠেছে— এতদিন ভূলোক উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল, আজ আকাশকে পর্যন্ত পাপে কলুষিত করে তুললে ; নিরুপায় আজ অতিমাত্র নিরুপায়- সমস্ত সুযোগ-সুবিধা আজ কেবল মানবসমাজের এক পাশে পুঞ্জীভূত, অন্য পাশে নিঃসহায়তা অন্তহীন । এরই কিছুদিন পূর্বে থেকে ঢাকার অত্যাচারের কাহিনী আমার মনের মধ্যে তোলপাড় করছিল । কী সব অমানুষিক নিষ্ঠুরতা, অথচ ইংলন্ডের খবরের কাগজে তার খবর নেই- এখানকার মোটরগাড়ির দুৰ্যোগে দুটাে-একটা মানুষ ম’লে তার খবর এ দেশের এক প্ৰান্ত থেকে আর-এক প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু আমাদের ধন প্রাণ মান কী অসম্ভব সন্তা হয়ে গেছে। যারা এত সস্তা তাদের সম্বন্ধে কখনাে সুবিচার হতেই পারে না । r t আমাদের নালিশ পৃথিবীর কানে ওঠবার জো নেই, সমস্ত রাস্তা বন্ধ । অথচ আমাদের বিরুদ্ধ বচন জগতে ব্যাপ্ত করবার সকলপ্রকার উপায় এদের হাতে । আজকের দিনে দুর্বল জাতির পক্ষে এও একটি প্রবলতম গ্রানির বিষয় । কেননা আজকের দিনের জনশ্রুতি সমস্ত জগতের কাছে ঘোষিত হয়, বাক্যচালনার যন্ত্রগুলো যে-সব শক্তিমান জাতির হাতে তারা অখ্যাতির এবং অপযশের আড়ালে অশক্তজাতীয়দের বিলুপ্ত করে রাখতে পারে । পৃথিবীর লোকের কাছে। এ কথা প্রচারিত যে, আমরা হিন্দু মুসলমানে কাটাকাটি মারামারি করি, অতএব ইত্যাদি । কিন্তু য়ুরোপেও একদা সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে কাটাকাটি মারামারি চলত- গেল কী উপায়ে । কেবলমাত্র শিক্ষাবিস্তারের দ্বারা । আমাদের দেশেও সেই উপায়েই যেত। কিন্তু শতাধিক বৎসরের ইংরেজ-শাসনের পরে দেশে শতকরা পাঁচজনের কপালে শিক্ষা জুটেছে, সে শিক্ষাও শিক্ষার বিড়ম্বনা । অবজ্ঞার কারণকে দূর করবার চেষ্টা না করে লোকের কাছে প্রমাণ করা যে, আমরা অবজ্ঞার যোগ্য,