পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(፩ % 8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী হবার বয়েস সাত-আট, বিদ্যালয় ত্যাগ করবার বয়েস ষোলো । এদের অধ্যয়নকাল আমাদের দেশের মতো লম্বা লম্বা ছুটি দিয়ে ফাক করে দেওয়া নয়, সুতরাং অল্পদিনে অনেক বেশি পড়তে পারে। এখানকার বিদ্যালয়ের মস্ত একটা গুণ, এরা যা পড়ে, তার সঙ্গে সঙ্গে ছবি আঁকে। তাতে পড়ার বিষয় মনে চিত্রিত হয়ে ওঠে, ছবির হাত পেকে যায়- আর পড়ার সঙ্গে রূপসৃষ্টি করার আনন্দ মিলিত হয় । হঠাৎ মনে হতে পারে, এরা বুঝি কেবলই কাজের দিকে ঝোক দিয়েছে গোয়ারের মতো ললিতকলাকে অবজ্ঞা ক’রে । একেবারেই তা নয় । সম্রাটের আমলের তৈরি বড়ো বড়ো রঙ্গশালায় উচ্চ অঙ্গের নাটক ও অপেরার অভিনয়ে বিলম্বে টিকিট পাওয়াই শক্ত হয় । নাটাভিনয়কলায় এদের মতো ওস্তাদ জগতে অল্পই আছে, পূর্বতন কালে আমীর-ওমরাওরাই সে-সমস্ত ভোগ করে এসেছেনতখনকার দিনে যাদের পায়ে না ছিল জুতো, গায়ে ছিল ময়লা ছেড়া কাপড়, আহার ছিল আধ-পেটী, দেবতা মানুষ সবাইকেই যারা অহােরাত্র ভয় করে করে বেড়িয়েছে, পরিত্রাণের জন্যে পুরুত-পাণ্ডাকে দিয়েছে ঘুষ, আর মনিবের কাছে ধূলোয় মাথা লুটিয়ে আত্মবিমাননা করেছে, তাদেরই ভিড়ে থিয়েটারে জায়গা পাওয়া যায় না । জনসাধারণের পক্ষে সহজে উপভোগ্য বলে মনে করা যায় না । কিন্তু শ্রোতারা গভীর মনোযোগের সঙ্গে সম্পূর্ণ নিঃশব্দে শুনছিল । অ্যাংলোস্যাকশন চাষী-মজুর শ্রেণীর লোকে এ জিনিস রাত্রি একটা পর্যন্ত এমন স্তব্ধ শান্ত ভাবে উপভোগ করছে। এ কথা মনে করা যায় না, আমাদের দেশের কথা ছেড়েই प्नों43 | আর-একটা উদাহরণ দিই। মস্কো শহরে আমার ছবির প্রদর্শনী হয়েছিল । এ ছবিগুলো সৃষ্টিছাড়া সে কথা বলা বাহুল্য। শুধু যে বিদেশী তা নয়, বলা চলে যে তারা কোনোদেশীই নয় । কিন্তু লোকের ঠেলা ঠেলি ভিড় । অল্প কয় দিনে পাচ হাজার লোক ছবি দেখেছে । আর যে যা বলক, অন্তত আমি তো। এদের রুচির প্রশংসা না করে থাকতে পারব না । রুচির কথা ছেড়ে দাও, মনে করা যাক এ একটা ফাঁকা কৌতুহল । কিন্তু কৌতুহল থাকাটাই যে জাগ্ৰত চিত্তের পরিচয় । মনে আছে একদা আমাদের ইদারার জন্যে আমেরিকা থেকে একটা বায়ুচল চক্ৰযন্ত্র এনেছিলুম, তাতে কুয়োর গভীর তলা থেকে জল উঠেছিল। কিন্তু যখন দেখলুম ছেলেদের চিত্তের গভীর তলদেশ থেকে একটুও কৌতুহল টেনে তুলতে পারলে না। তখন মনে বড়োই ধিক্কার লাগল। এই তো আমাদের ওখানে আছে বৈদ্যুত আলোর কারখানা, কজন ছেলের তাতে একটুও ঔৎসুক্য আছে ? অথচ এরা তো ভদ্রশ্রেণীর ছেলে। বুদ্ধির জড়তা যেখানে সেইখানে কৌতুহল দুবল । এখানে ইস্কুলের ছেলেদের আঁকা অনেকগুলি ছবি আমরা পেয়েছি— দেখে বিস্মিত হতে হয় । সেগুলো রীতিমত ছবি, কারও নকল নয়, নিজের উদ্ভাবন। এখানে নির্মাণ এবং সৃষ্টি দুইয়েরই প্রতি লক্ষ দেখে নিশ্চিন্ত হয়েছি । এখানে এসে অবধি স্বদেশের শিক্ষার কথা অনেক ভাবতে হয়েছে । আমার নিঃসহায় সামান্য শক্তি দিয়ে কিছু এর আহরণ এবং প্রয়োগ করতে চেষ্টা করব । কিন্তু আর সময় কই— আমার পক্ষে পাঞ্চবার্ষিক সংকল্পও হয়তো পূরণ না হতে পারে। প্ৰায় ত্ৰিশ বছর কাল যেমন একা একা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লগি ঠেলে কাটিয়েছি আরো দু-চার বছর তেমনি করেই ঠেলতে হবে।— বিশেষ এগোবে না। তাও জানি, তবু নালিশ করব না। আজ আর সময় নেই। আজ রাত্রের গাডিতে জাহাজের ঘাটের অভিমুখে যেতে হবে, সমুদ্রে কাল পাড়ি দেব। ইতি ২ অক্টোবর ১৯৩০