পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাশিয়ার চিঠি Gł 9. Gł ব্রেমেন স্টীমার অতলান্তিক রাশিয়া থেকে ফিরে এসে আজ চলেছি আমেরিকার ঘাটে । কিন্তু রাশিয়ার স্মৃতি আজও আমার সমস্ত মন অধিকার করে আছে । তার প্রধান কারণ- অন্যান্য যে-সব দেশে ঘুরেছি। তারা সমগ্রভাবে মনকে নাড়া দেয় না, তাদের নানা কর্মের উদ্যম আছে আপনি আপন মহলে । কোথাও আছে পলিটিকস, কোথাও আছে হাসপাতাল, কোথাও আছে বিশ্ববিদ্যালয়, কোথাও আছে ম্যুজিয়মবিশেষজ্ঞরা তাই নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে । কিন্তু এখানে সমস্ত দেশটা এক অভিপ্ৰায় মনে নিয়ে সমস্ত কর্মবিভাগকে এক স্নায়ুজালে জড়িত করে এক বিরাট দেহ এক বৃহৎ ব্যক্তিস্বরূপ ধারণ করেছে। সব-কিছু মিলে গেছে একটি অখণ্ড সাধনার মধ্যে । যে-সব দেশে অর্থ এবং শক্তির অধ্যবসায় ব্যক্তিগত স্বাৰ্থদ্বারা বিভক্ত সেখানে এরকম চিত্তের নিবিড় ঐক্য অসম্ভব । যখন এখানে পাঞ্চবার্ষিক য়ুরোপীয় যুদ্ধ চলছিল তখন দায়ে পড়ে দেশের অধিকাংশ ভাবনা ও কাজ এক অভিপ্ৰায়ে মিলিত হয়ে এক চিত্তের অধিকারে এসেছিল, এটা হয়েছিল অস্থায়ীভাবে । কিন্তু সোভিয়েট রাশিয়ায় যে কাণ্ড চলছে তার প্রকৃতিই এই— সাধারণের কাজ, সাধারণের চিত্ত, সাধারণের স্বত্ব বলে একটা অসাধারণ সত্তা এরা সৃষ্টি করতে লেগে গেছে । উপনিষদের একটা কথা আমি এখানে এসে খুব স্পষ্ট করে বুঝেছি- ‘মা গৃধঃ’, লোভ কোরো না । কেন লোভ করবে না । যেহেতু সমস্ত কিছু এক সত্যের দ্বারা পরিব্যাপ্ত ; ব্যক্তিগত লোভেতেই সেই একের উপলব্ধির মধ্যে বাধা আনে । “তেন তক্তেন ভুঞ্জীথাঃ- সেই একের থেকে যা আসছে তাকেই ভোগ করে । এরা আর্থিক দিক থেকে সেই কথাটা বলছে । সমস্ত মানবসাধারণের মধ্যে এরা একটি অদ্বিতীয় মানবসত্যকেই বড়ো বলে মনে- সেই একের যোগে উৎপন্ন যা-কিছু, এরা বলে, তাকেই সকলে মিলে ভোগ করে- “মা গধঃ কস্যস্বিদ্ধনং’- কারও ধনে লোভ কোরো না । কিন্তু ধনের ব্যক্তিগত বিভাগ থাকলেই ধনের লোভ, আপনিই হয় । সেইটিকে ঘুচিয়ে দিয়ে এরা বলতে চায়, “তেন ट7द्धन ढुोथle ।' যুরোপে অন্য সকল দেশেরই সাধনা ব্যক্তির লাভকে, ব্যক্তির ভোগকে নিয়ে । তারই মন্থন-আলোড়ন খুবই প্ৰচণ্ড, আর পৌরাণিক সমুদ্রমন্থনের মতোই তার থেকে বিষ ও সুধা দুইই উঠছে। কিন্তু সুধার ভাগ কেবল এক দলই পাচ্ছে অধিকাংশই পাচ্ছে না- এই নিয়ে অসুখ-অশান্তির সীমা নেই। সবাই মেনে নিয়েছিল। এইটেই অনিবাৰ্য ; বলেছিল মানবপ্রকৃতির মধ্যেই লোভ আছে এবং লোভের কাজই হচ্ছে ভোগের মধ্যে অসমান ভাগ করে দেওয়া । অতএব প্ৰতিযোগিতা চলবে এবং লড়াইয়ের জন্যে সর্বদা প্ৰস্তুত থাকা চাই । কিন্তু সোভিয়েটরা যা বলতে চায় তার থেকে বুঝতে হবে মানুষের মধ্যে ঐক্যটাই সত্য, ভাগটাই মায়া, সম্যক চিন্তা সম্যক চেষ্টা -দ্বারা সেটাকে যে মুহুর্তে মানব না। সেই মুহুর্তেই স্বপ্নের মতো সে লোপ পাবে। রাশিয়ায় সেই না-মানার চেষ্টা সমস্ত দেশ জুড়ে প্ৰকাণ্ড করে চলছে । সবা-কিছু এই এক চেষ্টার অস্তগত হয়ে গেছে । এইজন্যে রাশিয়ায় এসে একটা বিরাট চিত্তের স্পর্শ পাওয়া গেল । শিক্ষার বিরাটপর্ব আর কোনো দেশে এমন করে দেখি নি, তার কারণ অন্য দেশে শিক্ষা যে করে শিক্ষার ফল তারই— “দুধুভাতু খায় সেই ।” এখানে প্রত্যেকের শিক্ষায় সকলের শিক্ষা । একজনের মধ্যে শিক্ষার যে অভাব হবে সে অভাব সকলকেই লাগবে । কেননা সম্মিলিত শিক্ষারই যোগে এরা সম্মিলিত মনকে বিশ্বসাধারণের কাজে সফল করতে চায় । এরা বিশ্বকৰ্ম” ; অতএব এদের বিশ্বমনা হওয়া চাই । অতএব এদের জন্যেই যথার্থ বিশ্ববিদ্যালয় । শিক্ষা-ব্যাপারকে এরা নানা প্ৰণালী দিয়ে সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে । তার মধ্যে একটা হচ্ছে