পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাশিয়ার চিঠি C 이 이 সেইটে ব্যাখ্যা করা দরকার । ছবির পরস্পর-বৈপরীত্যদ্বারা তাদের বিশেষত্ব বোঝানো অনেক সময় কাজে লাগে । কিন্তু দর্শকদের মন একটুমাত্র শ্রান্ত হলেই তাদের তখনই ছুটি দেওয়া চাই । অশিক্ষিত দর্শকদের এরা কী করে ছবি দেখতে শেখায় তারই একটা রিপোর্ট থেকে উল্লিখিত কথাগুলি তোমাকে সংগ্ৰহ করে পাঠালুম । এর থেকে আমাদের দেশের লোকের যেটি ভাববার কথা আছে সেটি হচ্ছে এই— পূর্বে যে চিঠি লিখেছি তাতে আমি বলেছি, সমস্ত দেশকে কৃষিবলে যন্ত্রবলে অতিদ্রুতমাত্রায় শক্তিমান করে তোলবার জন্যে এরা একান্ত উদ্যমের সঙ্গে লেগে গেছে । এটা ঘোরতর কেজো কথা । অন্য-সব ধনী দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজের জোরে টিকে থাকবার জন্যে এদের এই বিপুল সাধনা ৷ আমাদের দেশে যখন এই-জাতীয় দেশব্যাপী রাষ্ট্রক সাধনার কথা ওঠে তখনই আমরা বলতে শুরু করি, এই একটিমাত্র লাল মশাল জ্বালিয়ে তুলে দেশের অন্য সকল বিভাগের সকল আলো নিবিয়ে দেওয়া চাই, নইলে মানুষ অন্যমনস্ক হবে । বিশেষত ললিতকলা সকল প্রকার কঠোর সংকল্পের বীণাটকে নিয়ে যদি লাঠি বানানো সম্ভব হয় তবেই সেটা চলবে, নতুবা নৈব নৈব চ । এই কথাগুলো যে কতখানি মেকি পৌরুষের কথা তা এখানে এলে স্পষ্ট বোঝা যায় । এখানে এরা দেশ জুড়ে কারখানা চালাতে যে-সব শ্রমিকদের পাকা করে তুলতে চায়, তারাই যাতে শিক্ষিত মন নিয়ে ছবির রস বুঝতে পারে তারই জন্যে এত প্ৰভূত আয়োজন । এরা জানে, রসজ্ঞ। যারা নয়। তারা বর্বর ; যারা বর্বর তারা বাইরে রুক্ষ, অস্তরে দুর্বল । রাশিয়ায় নবনাট্যকলার অসামান্য উন্নতি হয়েছে । এদের ১৯১৭ খ্রীস্টাব্দের বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গেই ঘোরতর দুদিন দুর্ভিক্ষের মধ্যেই এরা নেচেছে, গান গেয়েছে, নাট্যাভিনয় করেছে— এদের ঐতিহাসিক বিরাট নাট্যাভিনয়ের সঙ্গে তার কোনো বিরোধ ঘটে নি । মরুভূমিতে শক্তি নেই। শক্তির যথার্থ রূপ দেখা দেয় সেইখানেই যেখানে পাথরের বুক থেকে জলের ধারা কল্লোলিত হয়ে বেরিয়ে আসে, যেখানে বসন্তের রূপহিল্লোলে হিমাচলের গভীৰ্য মনোহর হয়ে ওঠে । বিক্ৰমাদিত্য ভারতবর্ষ থেকে শক শক্ৰদের তাডিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু কালিদাসকে নিষেধ করেন নি মেঘদূত লিখতে । জাপানীরা তলোয়ার চালাতে পারে না। এ কথা বলবার জো নেই, কিন্তু সমান নৈপুণ্যেই তারা তুলিও চালায় । রাশিয়ায় এসে যদি দেখতুম এরা কেবলই মজুর সেজে কারখানাঘরের সরঞ্জাম জোগাচ্ছে আর লাঙল চালাচ্ছে, তা হলেই বুঝতুম, এরা শুকিয়ে মরবো । যে বনস্পতি পল্লবমর্মর বন্ধ করে দিয়ে খাট খাট আওয়াজে অহংকার করে বলতে থাকে ‘আমার রসের দরকার নেই’। সে নিশ্চয়ই ছুতোরের দোকানের নকল বনস্পতি— সে খুবই শক্ত হতে পারে, কিন্তু খুবই নিস্ফল । অতএব আমি বীরুপুরুষদের বলে রাখছি। এবং তপস্বীদেরও সাবধান করে দিচ্ছি যে, দেশে যখন ফিরে যাব পুলিসের যষ্টিধারার শ্রাবণবৰ্ষণেও আমার নাচগান বন্ধ হবে না । রাশিয়ার নাট্যমঞ্চে যে কলাসাধনার বিকাশ হয়েছে সে অসামান্য । তার মধ্যে নূতন সৃষ্টির সাহস ক্ৰমাগতই দেখা দিচ্ছে, এখনো থামে নি । ওখানকার সমাজবিপ্লবে এই নূতন সৃষ্টিরই অসমসাহস কাজ করছে । এরা সমাজে রাষ্ট্রে কলাতত্ত্বে কোথাও নূতনকে ভয় করে নি । যে পুরাতন ধর্মতন্ত্র এবং পুরাতন রাষ্ট্রতন্ত্র বহু শতাব্দী ধরে এদের বুদ্ধিকে অভিভূত এবং প্ৰাণশক্তিকে নিঃশেষপ্রায় করে দিয়েছে এই সোভিয়েট-বিপ্লবীরা তাদের দুটােকেই দিয়েছে। নির্মল করে এত বড়ো বন্ধনজর্জর জাতিকে এত অল্পকালে এত বড়ো মুক্তি দিয়েছে দেখে মন আনন্দিত হয় । কেননা, যে ধর্ম মূঢ়তাকে বাহন করে মানুষের চিত্তের স্বাধীনতা নষ্ট করে, কোনো রাজাও তার : চেয়ে আমাদের বড়ো শক্র হতে পারে না— সে রাজা বাইরে থেকে প্রজাদের স্বাধীনতাকে যতই নিগড়িবদ্ধ করুক-না । এ-পর্যন্ত দেখা গেছে, যে রাজা প্ৰজাকে দাস করে রাখতে চেয়েছে সে রাজার সর্বপ্রধান সহায় সেই ধর্ম যা মানুষকে অন্ধ করে রাখে । সে ধর্ম বিষকন্যার মতো ; আলিঙ্গন করে সে মুগ্ধ করে, মুগ্ধ করে সে মারে । শক্তিশেলের চেয়ে ভক্তিশেল গভীরতর মর্মে গিয়ে প্রবেশ করে, কেননা তার মার আরামের মারি ।