পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাশিয়ার চিঠি G?) নয় । যারা যথার্থই দৌরাত্ম্য করতে চায় তারা মানুষের মনকে মারে আগে ; এরা মনের জীবনীশক্তি বাড়িয়ে তুলছে । এইখানেই পরিত্রাণের রাস্তা রয়ে গেল । আজ আর ঘণ্টা-কয়েকের মধ্যে পৌঁছব নিযুইয়র্কে । তার পরে আবার নতুন পালা। এরকম করে সাত ঘাটের জল খেয়ে বেড়াতে আর ভালো লাগে না । এবারে এ অঞ্চলে না। আসার ইচ্ছায় মনে অনেক তর্ক উঠেছিল, কিন্তু লোভই শেষকালে জয়ী হল । ইতি ৯ অক্টোবর ১৯৩০ S8 aन]क्राएछऐठेन्म ইতিমধ্যে দুই-একবার দক্ষিণ-দরজার কাছ ঘেঁষে গিয়েছি । মলয়-সামীরণের দক্ষিণদ্বার নয়, যে দ্বার দিয়ে প্ৰাণবায়ু বেরোবার পথ খোজে । ডাক্তার বললে, নাড়ীর সঙ্গে হৃৎপিণ্ডের মুহুর্তকালের যে বিরোধ ঘটেছিল সেটা যে অল্পের উপর দিয়েই কেটে গেছে এটাকে অবৈজ্ঞানিক ভাষায় মিরাকল বলা যেতে পারে । যাই হােক, যমদূতের ইশারা পাওয়া গেছে, ডাক্তার বলছে এখন থেকে সাবধান হতে হবে । অর্থাৎ উঠে হেঁটে বেড়াতে গেলেই বুকের কাছটাতে বাণ এসে লাগবে- শুয়ে পড়লেই লক্ষ্য এড়িয়ে যাবে । তাই ভালোমানুষের মতো আধ-শোওয়া অবস্থায় দিন কাটাচ্ছি । ডাক্তার বলে, এমন করে বছর-দশোক নিরাপদে কাটতে পারে, তার পরে দশম দশাকে কেউ ঠেকাতে পারে না । বিছানায় হেলান দিয়ে আছি, আমার লেখার লাইনও আমার দেহ-রেখার নকল করতে প্ৰবৃত্ত । রোসো, একটু উঠে বসি । দেখলুম, কিছু দুঃসংবাদ পাঠিয়েছ, শরীরের এ অবস্থায় পড়তে ভয় করে, পাছে ঢেউয়ের ঘায়ে ভাঙন লাগে । বিষয়টা কী তার আভাস পূর্বেই পেয়েছিলুম- বিস্তারিত বিবরণের ধাক্কা সহ্য করা আমার পক্ষে শক্তি । তাই আমি নিজে পড়ি নি, অমিয়াকে পড়তে দিয়েছি । যে বাধনে দেশকে জড়িয়েছে টান মেরে মেরে সেটা ছিড়তে হয় । প্রত্যেক টানে চোখের তারা উলটে যায়, কিন্তু এ ছাড়া বন্ধনমুক্তির অন্য উপায় নেই । ব্রিটিশরাজ নিজের বঁাধন নিজের হাতেই ছিড়ছে, তাতে আমাদের তরফে বেদনা যথেষ্ট, কিন্তু তার তরফে লোকসান কম নয় । সকলের চেয়ে বড়ো লোকসান এই যে, ব্রিটিশরাজ আপনি মান বুইয়েছে । ভীষণের দুৰ্বত্ততাকে আমরা ভয় করি, সেই ভয়ের মধ্যেও সম্মান আছে, কিন্তু কাপুরুষের দুৰ্বত্ততাকে আমরা ঘূণা করি । ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। আজ আমাদের ঘৃণার দ্বারা ধিককত । এই ঘূণায় আমাদের জোর দেবে, এই সুপার জোরেই আমরা জিতব । সম্প্রতি রাশিয়া থেকে এসেছি- দেশের গৌরবের পথ যে কত দুৰ্গম তা অনেকটা স্পষ্ট করে দেখলুম। যে অসহ্য দুঃখ পেয়েছে সেখানকার সাধকেরা পুলিসের মারা তার তুলনায় পুষ্পবৃষ্টি । দেশের ছেলেদের বোলো, এখনো অনেক বাকি আছে- তার কিছুই বাদ যাবে না । অতএব তারা যেন এখনই বলতে শুরু না করে যে বড়ো লাগছে- সে কথা বললেই গুণ্ডার লাঠিকে অর্ঘ্য দেওয়া হয় । দেশে বিদেশে ভারতবর্ষ আজি গৌরব লাভ করেছে কেবলমাত্র মারকে স্বীকার না করে- দুঃখকে উপেক্ষা করবার সাধনা আমরা যেন কিছুতে না ছাড়ি । পশুবলি কেবলই চেষ্টা করছে আমাদের পশুকে জাগিয়ে তুলতে, যদি সফল হতে পারে। তবেই আমরা হারব । দুঃখ পাচ্ছি। সেজন্যে আমরা দুঃখ করব না । এই আমাদের প্রমাণ করবার অবকাশ এসেছে যে, আমরা মানুষ- পশুর নকল করতে গেলেই এই শুভযোগ নষ্ট হবে । শেষ পর্যন্ত আমাদের বলতে হবে, ভয় করি নে। বাংলাদেশের মাঝে মাঝে ধৈৰ্য নষ্ট হয়, সেটাই আমাদের দুর্বলতা । আমরা যখন নখদন্ত মেলতে যাই তখনই তার দ্বারা নখীদন্তীীদের মেলাম করা হয় । উপেক্ষা কোরো, নকল কোরো না । অশ্রীবর্ষণ নৈব নৈব চ | আমার সব চেয়ে দুঃখ এই, যৌবনের সম্বল নেই। আমি পড়ে আছি গতিহীন হয়ে পাহশালায়যারা পথ চলছে তাদের সঙ্গে চলাবার সময় চলে গেছে । ইতি ২৮ অক্টোবর ১৯৩০