পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাশিয়ার চিঠি Gł SQ তুলনায় দেশকে শিক্ষিত করতে এই সুদীর্ঘকাল কত খরচ করা হয়েছে। দূরদেশবাসী ধনী শাসকের পক্ষে পুলিসের ডাণ্ডা অপরিহার্য কিন্তু সেই লাঠির বংশগত যাদের মাথার খুলি তাদের শিক্ষার ব্যয়বিধান বহু শতাব্দী মুলতবি রাখলেও কাজ চলে যায় । রাশিয়ায় পা বাড়িয়েই প্ৰথমেই চোখে পড়ল, সেখানকার যে চাষী ও শ্রমিক -সম্প্রদায়, আজ আট বৎসর পূর্বে, ভারতীয় জনসাধারণেরই মতো নিঃসহায় নিরন্ন নির্যাতিত নিরক্ষর ছিল, অনেক বিষয়ে যাদের দুঃখভার আমাদের চেয়ে বেশি বৈ কম ছিল না, অন্তত তাদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার এ অল্প কয় বৎসরের মধ্যেই যে উন্নতি লাভ করেছে। দেড়শো বছরেও আমাদের দেশে উচ্চশ্রেণীর মধ্যেও তা হয় নি। আমাদের দরিদ্রাণাং মনোরথাঃ স্বদেশের শিক্ষা সম্বন্ধে যে দুরাশার ছবি মরীচিকার পটে আঁকতে সাহস পায় নি। এখানে তার প্রত্যক্ষ রূপ দেখলুম দিগন্ত থেকে দিগন্তে বিস্তৃত । নিজেকে এ প্রশ্ন বারবার জিজ্ঞাসা করেছি- এতবড়ো আশ্চর্য ব্যাপার সম্ভবপর হল কী করে । মনের মধ্যে এই উত্তর পেয়েছি যে, লোভের বাধা কোনোখানে নেই । শিক্ষার দ্বারা সব মানুষই যথোচিত সক্ষম হয়ে উঠবে, এ কথা মনে করতে কোথাও খটকা লাগছে না। দূর এশিয়ার তুর্কমেনিস্তানবাসী প্রজাদেরও পুরোপুরি শিক্ষা দিতে এদের মনে একটুও ভয় নেই, প্ৰত্যুত প্রবল আগ্রহ আছে । তুর্কমেনিস্তানের প্রথাগত মৃঢ়তার মধ্যেই সেখানকার লোকের সমস্ত দুঃখের কারণ, এই কথাটা রিপোটে নির্দেশ করে উদাসীন হয়ে বসে নেই । কোচিন-চায়নায় শিক্ষাবিস্তার সম্বন্ধে শুনেছি, কোনো ফরাসী পাণ্ডিত্যব্যবসায়ী বলেছেন যে, ভারতবর্ষে ইংরেজ-রাজ দেশী লোককে শিক্ষা দিতে গিয়ে যে ভুল করেছেন ফ্রান্স যেন সে ভুল না। করেন । এ কথা মানতে হবে যে, ইংরেজের চরিত্রে এমন একটা মহত্ত্ব আছে যেজন্যে বিদেশী শাসননীতিতে তারা কিছু কিছু ভুল করে বসেন, শাসনের ঠাস বুনানিতে কিছু কিছু খেই হারায়, নইলে । আমাদের মুখ ফুটতে হয়তো আরো এক-আধ শতাব্দী দেরি হত । এ কথা অস্বীকার করবার জো নেই যে শিক্ষার অভাবে অশক্তি অটল হয়ে থাকে, অতএব অশিক্ষা পলিসের ডাণ্ডার চেয়ে কম বলবান নয় । বোধ হয় যেন লর্ড কার্জন সে কথাটা কিছু কিছু অনুভব করেছিলেন । শিক্ষাদান সম্বন্ধে ফরাসী পাণ্ডিত্যব্যবসায়ী স্বদেশের প্রয়োজনকে যে আদর্শে বিচার করে থাকেন, শাসিত দেশের প্রয়োজনকে সে আদর্শে করেন না । তার একমাত্র কারণ লোভ । লোভের করে থাকি । যাদের সঙ্গে ভারতের শাসনের সম্বন্ধ তাদের কাছে ভারতবর্ষ আজ দেড়শো বৎসর খর্ব হয়ে আছে । এইজন্যেই তার মর্মগত প্রয়োজনের পরে উপরওআলার ঔদাসীন্য ঘুচল না । আমরা যে কী অন্ন খাই, কী জলে আমাদের পিপাসা মেটাতে হয়, কী সুগভীর অশিক্ষায় আমাদের চিত্ত তম: বৃত, তা আজ পর্যন্ত ভালো করে তাদের চোখে পডল না । কেননা, আমরাই তাদের প্রয়োজনের এইটেই বড়ো কথা, আমাদেরও যে প্ৰাণগত প্ৰয়োজন আছে। এ কথাটা জরুরি নয় । তা ছাড়া আমরা এত অকিঞ্চিৎকর হয়ে আছি যে, আমাদের প্রয়োজনকে সম্মান করাই সম্ভব হয় না । ভারতের যে কঠিন সমস্যা, যাতে করে আমরা এতকাল ধরে ধনে প্ৰাণে মনে মরছি, এ সমস্যাটা পাশ্চাত্যে কোথাও নেই । সে সমস্যাটি এই যে, ভারতের সমস্ত স্বত্ব দ্বিধাকৃত ও সেই সর্বনেশে বিভাগের মূলে আছে লোভ । এই কারণে রাশিয়ায় এসে যখন সেই লোভকে তিরস্কৃত দেখলুম। তখন সেটা আমাকে যতবড়ো আনন্দ দিলে এতটা হয়তো স্বভাবত অন্যকে না দিতে পারে । তবুও মূল কথাটা মন থেকে তাড়াতে পারি নে, সে হচ্ছে এই যে, আজ কেবল ভারতে নয়, সমস্ত পৃথিবীতেই যে-কোনো বড়ো বিপদের জালবিস্তার দেখা যাচ্ছে তার প্রেরণা হচ্ছে লোভ— সেই লোভের সঙ্গেই যত ভয়, যত সংশয় ; সেই লোভের পিছনেই যত অস্ত্রসজ্জা, যত মিথ্যক ও নিষ্ঠুর রাষ্ট্রনীতি । আর-একটা তর্কের বিষয় হচ্ছে ডিকটেটরশিপ অর্থাৎ রাষ্ট্রব্যাপারে নায়কতন্ত্র নিয়ে । কোনো বিষয়েই নায়কিয়ানা আমি নিজে পছন্দ করি নে । ক্ষতি বা শাস্তির ভয়কে অগ্রবর্তী করে অথবা ভাষায় ভঙ্গীতে বা ব্যবহারে জিদ প্রকাশের দ্বারা, নিজের মত-প্রচারের রাস্তােটাকে সম্পূর্ণ সমতল করবার