পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Soo SR রবীন্দ্র-রচনাবলী মোট কথা হচ্ছে, আধুনিক কালে ব্যক্তিগত ধনসঞ্চয় ধনীকে যে প্রবল শক্তির অধিকার দিচ্ছে তাতে সর্বজনের সম্মান ও আনন্দ থাকতে পারে না । তাতে এক পক্ষে অসীম লোভ, অপর পক্ষে গভীর ঈর্ষা, মাঝখানে দুস্তর পার্থক্য । সমাজে সহযোগিতার চেয়ে প্রতিযোগিতা অসম্ভব বড়ো হয়ে উঠল । এই প্ৰতিযোগিতা নিজের দেশের এক শ্রেণীর সঙ্গে অন্য শ্রেণীর, এবং বাহিরে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের । তাই চার দিকে সংশয়হিংস্ৰ অস্ত্ৰ শাণিত হয়ে উঠছে, কোনো উপায়েই তার পরিমাণ কেউ খর্ব করতে পারছে না । আর, পরদেশী যারা এই দূরস্থিত ভোগীরাক্ষসের ক্ষুধা মেটাবার কাজে নিযুক্ত তাদের রক্তবিরল কৃশতা যুগের পর যুগে বেড়েই চলেছে । এই বহুবিস্তৃত কৃশতার মধ্যে পৃথিবীর অশান্তি বাসা বাধতে পারে না, এ কথা যারা বলদৰ্পে কল্পনা করে তারা নিজের গোয়ার্তমির অন্ধতার দ্বারা বিড়ম্বিত । যারা নিরন্তর দুঃখ পেয়ে চলেছে সেই হতভাগারাই দুঃখবিধাতার প্রেরিত দূতদের প্রধান সহায় ; তাদের উপবাসের মধ্যে প্রলয়ের আগুন সঞ্চিত হচ্ছে । বর্তমান সভ্যতার এই অমানবিক অবস্থায় বলশেভিক নীতির অভ্যুদয় ; বায়ুমণ্ডলের এক অংশে তনুত্ব ঘটলে ঝড় যেমন বিদ্যুদন্ত পেষণ করে মারমূর্তি ধরে ছুটে আসে এও সেইরকম কাণ্ড । মানবসমাজের সামঞ্জস্য ভেঙে গেছে বলেই এই একটা অপ্রাকৃতিক বিপ্লবের প্রাদুর্ভাব । সমষ্টির প্রতি ব্যষ্টির উপেক্ষা ক্রমশই বেড়ে উঠছিল বলেই সমষ্টির দোহাই দিয়ে আজ ব্যষ্টিকে বলি দেবার আত্মঘাতী প্ৰস্তাব উঠেছে। তীরে অগ্নিগিরি উৎপাত বাধিয়েছে বলে সমুদ্রকেই একমাত্র বন্ধু বলে এই ঘোষণা । তীরহীন সমুদ্রের রীতিমত পরিচয় যখন পাওয়া যাবে তখন কুলে ওঠবার জন্যে আবার আঁকুবাকু করতে হবে । সেই ব্যষ্টিবর্জিত সমষ্টির অবাস্তবতা কখনোই মানুষ চিরদিন সইবে না । সমাজ থেকে লোভের দুর্গগুলোকে জয় করে আয়ত্ত করতে হবে, কিন্তু ব্যক্তিকে বৈতরণী পার করে দিয়ে সমাজরক্ষা করবে কে । অসম্ভব নয় যে, বর্তমান রুগণ যুগে বলশেভিক নীতিই চিকিৎসা ; কিন্তু চিকিৎসা তো নিত্যকালের হতে পারে না, বস্তুত ডাক্তারের শাসন যেদিন ঘুচিবে সেইদিনই রোগীর শুভদিন । আমাদের দেশে আমাদের পল্লীতে পানীতে ধন- উৎপাদন ও পরিচালনার কাজে সমবায়নীতির জয় হোক, এই আমি কামনা করি । কারণ, এই নীতিতে যে সহযোগিতা আছে তাতে সহযোগীদের ইচ্ছাকে চিন্তাকে তিরস্কৃত করা হয় না বলে মানবপ্রকৃতিকে স্বীকাব করা হয় । সেই প্ৰকৃতিকে বিরুদ্ধ করে দিয়ে জোর খাটাতে গেলে সে জোর খাটবে না । এই সঙ্গে একটা কথা বিশেষ করে বলা দরকার । আমি যখন ইচ্ছা করি যে আমাদের দেশের গ্রামগুলি বেঁচে উঠক, তখন কখনো ইচ্ছে করি নে যে গ্ৰাম্যতা ফিরে আসুক । গ্ৰাম্যতা হচ্ছে সেইরকম সংস্কার, বিদ্যা, বুদ্ধি, বিশ্বাস ও কর্ম যা গ্রামসীমার বাইরের সঙ্গে বিযুক্ত- বর্তমান যুগের যে প্রকৃতি তার সঙ্গে যা কেবলমাত্র পৃথক নয়, যা বিরুদ্ধ। বর্তমান যুগের বিদ্যা ও বুদ্ধির ভূমিকা বিশ্বব্যাপী, যদিও তার হৃদয়ের অনুবেদনা সম্পূৰ্ণ সে পরিমাণে ব্যাপক হয় নি। গ্রামের মধ্যে সেই প্ৰাণ আনতে হবে যে প্ৰাণের উপাদান তুচ্ছ ও সংকীর্ণ নয়, যার দ্বারা মানবপ্রকৃতিকে কোনো দিকে খর্ব ও তিমিরাবৃত না রাখা হয় । ইংলন্ডে একদা কোনো-এক গ্রামে একজন কৃষকের বাড়িতে ছিলুম। দেখলুম, লন্ডনে যাবার জন্যে ঘরের মেয়েগুলির মন চঞ্চল । শহরের সর্ববিধ ঐশ্বর্যের তুলনায় গ্রামের সম্বলের এত দীনতা যে, গ্রামের চিত্তকে স্বভাবতই সর্বদা শহরের দিকে টানছে । দেশের মাঝখানে থেকেও গ্রামগুলির যেন নির্বাসন । রাশিয়ায় দেখেছি, গ্রামের সঙ্গে শহরের বৈপরীত্য ঘুচিয়ে দেবার চেষ্টা । এই চেষ্টা যদি ভালো করে সিদ্ধ হয় তা হলে শহরে অস্বাভাবিক অতিবৃদ্ধি নিবারণ হবে । দেশের প্রাণশক্তি চিন্তাশক্তি দেশের সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে আপন কাজ করতে পারবে । আমাদের দেশের গ্রামগুলিও শহরের উচ্ছিষ্ট ও উদ্যবৃত্ত -ভোজী না হয়ে মনুষ্যত্বের পূর্ণ সম্মান ও সম্পদ ভোগ করুক, এই আমি কামনা করি । একমাত্র সমবায়প্ৰণালীর দ্বারাই গ্রাম। আপনি সর্বাঙ্গীণ শক্তিকে নিমজনদশা থেকে উদ্ধার করতে পারবে, এই আমার বিশ্বাস । আক্ষেপের বিষয। এই যে, আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে সমবায়প্ৰণালী কেবল টাকা ধার দেওয়ার মধ্যেই স্নান হয়ে আছে, মহাজনী