পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

NgObr রবীন্দ্র-রচনাবলী বিদেশে আমাকে অনেকে জিজ্ঞাসা করেছেন- যাকে ওরা "হ্যাপিনেস বলেন, আমরা বলি সুখ, এর আধার কোথায় । মানুষ সুখী হয়। সেখানেই যেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ সত্য হয়ে ওঠে- এ কথাটি বলাই বাহুল্য । কিন্তু আজকের দিনে এটা বলার প্রয়োজন হয়েছে। কেননা, এই সম্বন্ধকে বাদ দিয়ে যেখানে ব্যাবসাঘটিত যোগ সেখানে মানুষ এত প্রচুর ফললাভ করে- বাইরের ফল- এত তাতে মুনাফা হয়, এতিরকম সুযোগ-সুবিধা মানুষ পায় যে মানুষের বলবার সাহস থাকে না, এটাই সভ্যতার চরম বিকাশ নয়। এত পায় ! এত তার শক্তি ! যন্ত্ৰযোগে যে শক্তি প্রবল হয়ে ওঠে তার দ্বারা এমনি করে সমস্ত পৃথিবীকে সে অভিভূত করেছে, বিদেশের এত লোককে তার নিজের দাসত্বে ব্ৰতী করতে পেরেছে- তার এত অহংকার । আর, সেইসঙ্গে এমন অনেক সুযোগ-সুবিধা আছে যা বস্তুত মানুষের জীবনযাত্রার পথে অত্যন্ত অনুকুল । সেগুলি ঐশ্বর্যযোগে উদভূত হয়েছে। এগুলিকে চরম লাভ বলে মানুষ সহজেই মনে করে । না মনে করে থাকতে পারে না । এর কাছে সে বিকিয়ে দিয়েছে মানুষের সকলের চেয়ে বড়ো জিনিস, সে হল মানবসম্বন্ধ । মানুষ বন্ধুকে চায়, যারা সুখে দুঃখে আমার আপনি, যাদের কাছে বসে আলাপ করলে খুশি হই, যাদের বাপ-মারি সঙ্গে আমার সম্বন্ধ ছিল, যাদের আমার পিতৃস্থানীয় বলে জেনেছি, যাদের ছেলেরা আমার পুত্রসন্তানের স্থানীয় । এ-সব পরিমণ্ডলীর ভিতর মানুষ আপনার মানবত্বকে উপলব্ধি করে । এ কথা সত্য, একটা প্ৰকাণ্ড দানবীয় ঐশ্বর্যের মধ্যে মানুষ আপনার শক্তিকে অনুভব করে । সেও বহুমূল্য, আমি তাকে অবজ্ঞা করব না । কিন্তু সেই শক্তিবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে যদি মানুষী সৃষ্টি করে, অনেক নিষ্ঠুরতাকে পালন করে, অনেক বিষবৃক্ষের বীজ রোপন করে সমাজে । এ হতেই হবে । দরদ যখন চলে যায়, মানুষ অধিকাংশ মানুষকে যখন প্রয়োজনীয় সামগ্ৰীীর মতো দেখতে অভ্যস্ত হয়, লক্ষ লক্ষ মানুষকে যখন দেখে তারা আমার কলের চাকা চালিয়ে আমার কাপড় সস্তা করবে, আমার খাবার জুগিয়ে দেবে, আমার ভোগের উপকরণ সুগম করবে- এইভাবে যখন মানুষকে, দেখতে অভ্যস্ত হয় তখন তারা মানুষকে দেখে না, মানুষের মধ্যে কলকে দেখে । এখানে চালের কল আছে । সেই কল-দানবের চাকা সাওতাল ছেলেমেয়েরা । ধনী তাদের কি মানুষ মনে করে । তাদের সুখদুঃখের কি হিসেব আছে। প্রতিদিনের পাওনা শুনে দিয়ে তার কাছে কষে রক্ত শুষে কাজ আদায় করে নিচ্ছে । এতে টাকা হয়, সুখও হয়, অনেক হয়, কিন্তু বিকিয়ে যায় মানুষের সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মানবত্ব । দয়ামায়া, পরস্পরের সহজ আনুকুল্য, দরদ- কিছু থাকে না । কে দেখে তাদের ঘরে কী হয়েছে না হয়েছে । একসময় আমাদের গ্রামে উচ্চনীচের ভেদ ছিল না। তা সুখদুঃখের উপর সকলের দৃষ্টি ছিল । পরস্পর সম্মিলিত হয়ে একত্রীভূত একটা জীবনযাত্রা তারা তৈরি করে তুলেছিল। পূজাপার্বণে আনন্দ-উৎসবে সকল সম্বন্ধে প্রতিদিন তারা নানারকমে মিলিত হয়েছে। চণ্ডীমণ্ডপে এসে গল্প করেছে দাদাঠাকুরের সঙ্গে । যে অন্ত্যজ সেও একপাশে বসে আনন্দের অংশ গ্ৰহণ করেছে। উপর-নীচ জ্ঞানী-অজ্ঞানীর মাঝখানে যে রাস্তা যে সেতু সেটা খোলা ছিল। আমি পল্লীর কথা বলছি, কিন্তু মনে রেখো- পীই তখন সব ; শহর তখন নগণ্য বলতে চাই না, কিন্তু গৌণ, মুখ্য নয়, প্রধান নয়। পল্লীতে পল্লীতে কত পণ্ডিত, কত ধনী, কত মানী, আপনার পল্পীকে জন্মস্থানকে আপনার করে বাস করেছে। সমস্ত জীবন হয়তো নবাবের ঘরে, দরবারে কাজ করেছে। যা-কিছু সম্পদ তারা পটীতে এনেছে । সেই অর্থে টোল চলেছে, পাঠশালা বসেছে, রান্তাঘাট হয়েছে, অতিথিশালা, যাত্ৰা-পূজা-অৰ্চনায় গ্রামের মনপ্রাণ এক হয়ে মিলেছে। গ্রামে আমাদের দেশের প্রাণপ্ৰতিষ্ঠা ছিল, তার কারণ গ্রামে মানুষের সঙ্গে মানুষের যে সামাজিক সম্বন্ধ সেটা সত্য হতে পারে । শহরে তা সম্ভব নয় । অতএব সামাজিক মানুষ আশ্রয় পায় গ্রামে। আর, সামাজিক মানুষের জন্যই তো সব । ধর্মকর্ম সামাজিক মানুষেরই জন্য । লক্ষপতি ক্রোড়পতি টাকার থলি নিয়ে গদিয়ান হয়ে