পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাশিয়ার চিঠি ܠ ܠ ܣܠܠ সভ্যতা-বিনাশের কারণ সন্ধান করলে একটিমাত্র কারণ পাওয়া যায়, সে হচ্ছে মানবসম্বন্ধের বিকৃতি বা ব্যাঘাত । যারা ক্ষমতাশালী ও যারা অক্ষম তাদের মধ্যেকার ব্যবধান প্রশস্ত হয়ে সেখানে সামাজিক সামঞ্জস্য নষ্ট হয়েছে । সেখানে প্রভুর দলে, দাসের দলে, ভোগীর দিলে, অভূক্তের দলে, সমাজকে দ্বিখণ্ডিত করে সমাজদেহে প্ৰাণপ্ৰবাহের সঞ্চরণকে অবরুদ্ধ করেছে ; তাতে এক অঙ্গের অতিপুষ্টি এবং অন্য অঙ্গের অতিশীৰ্ণতায় রোগের সৃষ্টি হয়েছে ; পৃথিবীর সকল সভ্য দেশেই এই ছিদ্র দিয়ে আজ যমের চর আনাগোনা করছে । আমাদের দেশে তার প্রবেশপথ অন্য দেশের চেয়ে আরো যেন অবারিত । এই দুর্ঘটনা সম্প্রতি ঘটেছে । একদিন আমাদের দেশে পল্লীসমাজ সজীব ছিল । এই সমাজের ভিতর দিয়েই ছিল সমস্ত দেশের যোগবন্ধন, আমাদের সমস্ত শিক্ষাদীক্ষা ধর্মকর্মের প্রবাহ পল্লীতে পল্লীতে ছিল সঞ্চারিত । দেশের বিরাট চিত্ত পল্লীতে পল্লীতে প্রসারিত হয়ে আশ্রয় পেয়েছে, প্রাণ পেয়েছে। এ কথা সত্য যে, আধুনিক অনেক জ্ঞানবিজ্ঞান সুযোগসুবিধা থেকে আমরা বঞ্চিত ছিলুম । তখন আমাদের চেষ্টার পরিধি ছিল সংকীর্ণ, বৈচিত্ৰ্য ছিল স্বল্প, জীবনযাত্রার আয়োজনে উপকরণে অভাব ছিল বিস্তর । কিন্তু, সামাজিক প্ৰাণক্রিয়ার যোগ ছিল অবিচ্ছিন্ন । এখন তা নেই । নদীতে স্রোত যখন বহমান থাকে তখন সেই স্রোতের দ্বারা এপারে ওপারে, এ দেশে ও দেশে, আনাগোনা-দেনাপাওনার যোগ রক্ষা হয় । জল যখন শুকিয়ে যায়। তখন এই নদীরই খাত বিষম বিঘ্ন হয়ে ওঠে । তখন এক কালের পথটাই হয় অন্য কালের অপথ । বর্তমানে তাই ঘটেছে । যাদের আমরা ভদ্রসাধারণ নাম দিয়ে থাকি তারা যে বিদ্যালাভ করে, তাদের যা আকাঙক্ষা ও সাধনা, তারা যে-সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকে, সে-সব হল মরা নদীর শুষ্ক গহবরের এক পাডিতে— তার অপর পাড়ির সঙ্গে জ্ঞান-বিশ্বাস আচার-অভ্যাস দৈনিক জীবনযাত্রায় দুস্তর দূরত্ব । গ্রামের লোকের না আছে বিদ্যা, না আছে আরোগ্য, না আছে সম্পদ, না আছে। অন্নবস্ত্ৰ । ও দিকে যারা কলেজে পডে, ওকালতি করে, ডাক্তারি করে, ব্যাঙ্কে টাকা জমা দেয়, তারা রয়েছে দ্বীপের মধ্যে ; চারি দিকে অতলস্পর্শ বিচ্ছেদ । যে স্নায়ুজালের যোগে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বেদনা দেহের মর্মস্থানে পৌঁছয়, সমস্ত দেহের আত্মবোধ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বোধের সম্মিলনে সম্পূৰ্ণ হয় তার মধ্যে যদি বিচ্ছিন্নতা ঘটে। তবে তো মরণব্দশা । সেই দশা আমাদের সমাজে । দেশকে মুক্তিদান করবার জন্যে আজ যারা উৎকট অধ্যবসায়ে প্রবৃত্ত এমন-সব লোকের মধ্যেও দেখা যায়, সমাজের মধ্যে গুরুতর ভেদ যেখানে, যেখানে পক্ষাঘাতের লক্ষণ, সেখানে তাদের দৃষ্টিই পড়ে না । থেকে থেকে বলে ওঠেন, কিছু করা চাই । কিন্তু কণ্ঠের সঙ্গে সঙ্গে হাত এগোয় না । দেশ সম্বন্ধে আমাদের যে উদ্যোগ তার থেকে দেশের লোক বাদ পড়ে । এটা আমাদের এতই অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে, এর বিপুল বিড়ম্বনা সম্বন্ধে আমাদের বোধ নেই। একটা তার দৃষ্টান্ত দিই । TA আমাদের দেশে আধুনিক শিক্ষাবিধি বলে একটা পদার্থের আবির্ভাব হয়েছে। তারই নামে স্কুল কলেজ ব্যাঙের ছাতার মতো ইতস্তত মাথা তুলে উঠেছে। এমন ভাবে এটা তৈরি যে, এর আলো কলেজি মণ্ডলের বাইরে অতি অল্পই পৌছয়- সূর্যের আলো চাদের আলোয় পরিণত হয়ে যতটুকু বিকীর্ণ হয় তার চেয়েও কম। বিদেশী ভাষার স্কুল বেড়া তার চার দিকে । মাতৃভাষার যোগে শিক্ষাবিস্তার সম্বন্ধে যখন চিন্তা করি সে চিন্তার সাহস অতি অল্প । সে যেন অন্তঃপুরিকা বধূর মতোই ভীরু । আঙিনা পর্যন্তই তার অধিকার, তার বাইরে চিবুক পেরিয়ে তার ঘোমটা নেমে পড়ে । মাতৃভাষার আমল প্রাথমিক শিক্ষার মধ্যেই, অর্থাৎ সে কেবল শিশুশিক্ষারই যোগ্য- অর্থাৎ মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা শেখবার সুযোগ নেই, সেই বিরাট জনসংঘকে বিদ্যার অধিকার সম্বন্ধে চিরশিশুর মতোই গণ্য করা হয়েছে। তারা কোনোমতেই পুরো মানুষ হয়ে উঠবে না, অথচ স্বরাজ সম্বন্ধে তারা পুরো মানুষের অধিকার লাভ করবে, চোখ বুজে এইটে আমরা কল্পনা করি । জ্ঞানলাভের ভাগ নিয়ে দেশের অধিকাংশ জনমণ্ডলী সম্বন্ধে এতবড়ো অনশনের ব্যবস্থা