পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ܓ ܠ ܟܠ আর-কোনো নবজাগ্ৰত দেশে নেই- জাপানে নেই, পারস্যে নেই, তুরস্কে নেই, ইজিপ্টে নেই। যেন মাতৃভাষা একটা অপরাধ, যাকে খৃস্টান ধর্মশাস্ত্ৰে বলে আদিম পাপ । দেশের লোকের পক্ষে "ইংরেজি হােটেলওয়ালার দোকান ছাড়া আর কোথাও দেশের লোকের পুষ্টিকর অন্ন মিলবেই না’ এমন কথা বলাও যা আর ইংরেজি ভাষা ছাড়া মাতৃভাষার যোগে জ্ঞানের সম্যক সাধনা হতেই পারবে না।” এও বলা তাই । এই উপলক্ষে এ কথা মনে রাখা দরকার যে, আধুনিক সমস্ত বিদ্যাকে জাপানী ভাষার সম্পূৰ্ণ আয়ত্তগম্য করে তবে জাপানী বিশ্ববিদ্যালয় দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে সত্য ও সম্পূৰ্ণ করে তুলেছে । তার কারণ, শিক্ষা বলতে জাপান সমস্ত দেশের শিক্ষা বুঝেছে— ভদ্রলোক বলে এক সংকীর্ণ শ্রেণীর শিক্ষা বোঝে নি। মুখে আমরা যাই বলি, দেশ বলতে আমরা যা বুঝি সে হচ্ছে ভদ্রলোকের দেশ । জনসাধারণকে আমরা বলি, ছোটোলোক ; এই সংজ্ঞাটা বহুকাল থেকে আমাদের অস্থিমজ্জায় প্রবেশ করেছে । ছোটোলোকদের পক্ষে সকলপ্রকার মাপকাঠিই ছোটো । তারা নিজেও সেটা স্বীকার করে প্রকাশ অনুজ্জ্বল, অথচ দেশের অধিকাংশই তারা, সুতরাং দেশের অন্তত বারো-আনা অনালোকিত । ভদ্রসমাজ তাদের স্পষ্ট করে দেখতেই পায় না, বিশ্বসমাজের তো কথাই নেই । রাষ্ট্রীয় আলোচনার মত্ত অবস্থায় আমরা মুখে যাই কিছু বলি-না কেন, দেশাভিমান যত তারস্বরে প্ৰকাশ করি।-না কেন, আমাদের দেশ প্ৰকাশহীন হয়ে আছে বলেই কর্মের পথ দিয়ে দেশের সেবায় আমাদের এত ঔদাসীন্য । যাদের আমরা ছোটো করে রেখেছি মানবস্বভাবের কৃপণতাবশত তাদের আমরা অবিচার করেই থাকি । তাদের দোহাই দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে অর্থসংগ্ৰহ করি ; কিন্তু তাদের ভাগে পড়ে। বাক্য, অর্থটা অবশেষে আমাদের দলের লোকের ভাগ্যেই এসে জোটে । মোট কথাটা হচ্ছে, ...দেশের যে অতিক্ষুদ্র অংশে বুদ্ধি বিদ্যা ধন মান, সেই শতকরা পাচ পরিমাণ লোকের সঙ্গে পচানব্বই পরিমাণ লোকের ব্যবধান মহাসমুদ্রের ব্যবধানের চেয়ে বেশি । আমরা এক দেশে আছি, অথচ यभidद 625 0 = व्य ! শিশুকালে আমাদের ঘরে যে সেজের দীপ জ্বলত তার এক অংশে অল্প তেল অপর অংশে অনেকখানি জল ছিল । জলের অংশ ছিল নীচে, তেলের অংশ ছিল উপরে । আলো মিটমিট করে জ্বলত, অনেকখানি ছড়ােত ধোয়া । এটা কতকটা আমাদের সাবেক কালের অবস্থা । ভদ্রসাধারণ এবং ইতরসাধারণের সম্বন্ধটা এইরকমই ছিল । তাদের মর্যাদা সমান নয়। কিন্তু তবুও তারা উভয়ে একত্ৰ মিলে একই আলো জ্বালিয়ে রেখেছিল । তাদের ছিল একটা অখণ্ড আধার । আজকের দিনে তেল গিয়েছে এক দিকে, জল গিয়েছে আর-এক দিকে ; তেলের দিকে আলোর উপাদান অতি সামান্য, জলের দিকে একেবারেই নেই । বয়স যখন হল, ঘরে এল কেরোসিনের ল্যাম্প বিদেশ থেকে ; তাতে সবটাতেই এক তেল, সেই তেলের সমস্তটার মধ্যেই উদ্দীপনার শক্তি । আলোর উজ্জ্বলতাও বেশি । এর সঙ্গে যুরোপীয় সভ্যসমাজের তুলনা করা যেতে পারে । সেখানে এক জাতেরই বিদ্যা ও শক্তি দেশের সকল লোকের মধ্যেই ব্যাপ্ত । সেখানে উপরিতল নিম্নতল আছে, সেই উপরিতলের কাছেই বাতি দীপ্ত হয়ে জ্বলে, নীচের তল অদীপ্ত । কিন্তু, সেই ভেদ অনেকটা আকস্মিক ; সমস্ত তেলের মধ্যেই দীপ্তির শক্তি আছে । সে হিসাবে জ্যোতির জাতিভেদ নেই ; নীচের তেল যদি উপরে ওঠে তা হলে উজ্জ্বলতার তারতম্য ঘটে না । সেখানে নীচের দলের পক্ষে উপরের দলে উত্তীৰ্ণ হওয়া অসাধ্য নয় ; সেই চেষ্টা নিয়তই be আর-এক শ্রেণীর বাতি আছে তাকে বলি বিজলি বাতি । তার মধ্যে তারের কুণ্ডলী আলো দেয়, তার আগাগোড়াই সমান প্ৰদীপ্ত । তার মধ্যে দীপ্ত-অর্দিীপ্তের ভেদ নেই ; এই আলো দিবালোকের প্রায় সমান । যুরোপীয় সমাজে এই বাতি জ্বালাবার উদ্যোগ সব দেশে এখন চলছে না ; কিন্তু কোথাও