পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাশিয়ার চিঠি VaYVU) কোথাও শুরু হয়েছে- এর যন্ত্রটাকে পাকা করে তুলতে হয়তো এখনো অনেক ভাঙচুর করতে হবে, যন্ত্রের মহাজন কেউ কেউ হয়তো দেউলে হয়ে যেতেও পারে, কিন্তু পশ্চিম মহাদেশে এই দিকে একটা ঝোক পড়েছে সে কথা আর গোপন করে রাখবার জো নেই। এইটে হচ্ছে প্রকাশের চেষ্টা, মানুষের অন্তনিহিত ধর্ম ; এই ধর্মসাধনায় সকল মানুষই অব্যাহত অধিকার লাভ করবে। এইরকমের একটা প্ৰয়াস ক্রমশই যেন ছড়িয়ে পড়ছে। কেবল আমাদের হতভাগ্য দেশে দেখি, মাটির প্রদীপে যে আলো একদিন এখানে জ্বলেছিল তাতেও আজ বাধা পড়ল । আজ আমাদের দেশের ডিগ্রিধারীরা পল্লীর কথা যখন ভাবেন তখন তাদের জন্যে অতি সামান্য ওজনে কিছু করাকেই যথেষ্ট বলে মনে করেন । যতক্ষণ আমাদের এইরকমের মনোভাব ততক্ষণ পল্লীর লোকেরা আমাদের পক্ষে বিদেশী । এমন-কি, তার চেয়েও তারা বেশি পর, তার কারণ এই- আমরা স্কুলে কলেজে যেটুকু বিদ্যা পাই সে বিদ্যা য়ুরোপীয় । সেই বিদ্যার সাহায্যে য়ুরোপীয়কে বোঝা ও য়ুরোপীয়ের কাছে নিজেকে বোঝানো আমাদের পক্ষে সহজ। ইংলন্ড ফ্রান্স জার্মানির চিত্তবৃত্তি আমাদের কাছে সহজে প্ৰকাশমান ; তাদের কাব্য গল্প নাটক যা আমরা পড়ি সে। আমাদের কাছে হেঁয়ালি নয় ; এমন-কি, যে কামনা, যে তপস্যা তাদের, আমাদের কামনা-সাধনাও অনেক পরিমাণে তারই পথ নিয়েছে। কিন্তু, যারা মা-বতী মনসা ওলাবিবি শীতলা ঘেটু রাহু শনি ভূত প্রেতি ব্ৰহ্মদৈত্য গুপ্তপ্রেস-পাঁজিকা পাণ্ডা পুরুতের আওতায় মানুষ হয়েছে তাদের থেকে আমরা খুব বেশি উপরে উঠেছি তা নয়, কিন্তু দূরে সরে গিয়েছি- পরস্পরের মধ্যে ঠিকমত সাড়া চলে না । তাদের ঠিকমত পরিচয় নেবার উপযুক্ত কৌতুহল পর্যন্ত আমাদের নেই। আমাদের কলেজে যারা ইকনমিকস এথনোলজি পড়ে তারা অপেক্ষা করে থাকে যুরোপীয় পণ্ডিতের- পাশে গ্রামের লোকের আচার বিচার বিধিব্যবস্থা জানিবার জন্যে । ওরা ছোটোলোক, আমাদের মনে মানুষের প্রতি যেটুকু দরদ আছে তাতে করে ওরা আমাদের কাছে দৃশ্যমান নয়। পশ্চিম মহাদেশের নানাপ্রকার ‘মুভমেন্ট’-এর পূর্বাপর ইতিহাস ঐরা পড়েছেন । আমাদের জনসাধারণদের মধ্যেও নানা মুভমেন্ট চলে আসছে, কিন্তু সে আমাদের শিক্ষিত-সাধারণের অগোচরে । জানিবার জন্যে কোনো ঔৎসুক্য নেই ; কেননা তাতে পরীক্ষা-পাসের মার্ক মেলে না । দেশের সাধারণের মধ্যে আউল বাউল কত সম্প্রদায় আছে, সেটা একেবারে অবজ্ঞার বিষয় নয় ; ভদ্রসমাজের মধ্যে নূতন নূতন ধর্মপ্ৰচেষ্টার চেয়ে তার মধ্যে অনেক বিষয়ে গভীরতা আছে ; সে-সব সম্প্রদায়ের যে সাহিত্য তাও শ্রদ্ধা করে রক্ষা করবার যোগ্য- কিন্তু ‘ওরা ছোটোলোক । সকল দেশেই নৃত্য কলাবিদ্যার অন্তৰ্গত, ভাবপ্রকাশের উপায় রূপে শ্ৰদ্ধা পেয়ে থাকে । আমাদের দেশে ভদ্রসমাজে তা লোপ পেয়ে গেছে বলে আমরা ধরে রেখেছি সেটা আমাদের নেই। অথচ জনসাধারণের নৃত্যকলা নানা আকারে এখনো আছে- কিন্তু ‘ওরা ছোটােলোক” । অতএব ওদের যা আছে সেটা আমাদের নয়। এমন-কি, সুন্দর সুনিপুণ হলেও সেটা আমাদের পক্ষে লজার বিষয় । ক্রমে হয়তো এ-সমস্তই লোপ হয়ে যাচ্ছে ; কিন্তু সেটাকে আমরা দেশের স্মৃতি বলেই গণ্য করি নে, কেননা বস্তুতই ওরা আমাদের দেশে নেই । কবি বলেছেন, “নিজ বাসভূমে পরিবাসী হলে ?” তিনি এইভাবেই বলেছিলেন যে, আমরা বিদেশীয় শাসনে আছি। তার চেয়ে সত্যতার গভীরতর ভাবে বলা চলে যে, আমাদের দেশে আমরা পরবাসী, অর্থাৎ আমাদের জাতের অধিকাংশের দেশ আমাদের দেশ নয় । সে দেশ আমাদের অদৃশ্য, অস্পৃশ্য । যখন দেশকে মা বলে আমরা গলা ছেড়ে ডাকি তখন মুখে যাই বলি মনে মনে জানি, সে মা শুটিকয়েক আদুরে ছেলের মা। এই করেই কি আমরা বঁচিব । শুধু ভোট দেবার অধিকার পেয়েই আমাদের চরম পরিত্ৰাণ ? এই দুঃখেই দেশের লোকের গভীর ঔদাসীন্যের মাঝখানে, সকল লোকের আনুকুল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে, এখানে এই গ্ৰাম-কয়টির মধ্যে আমরা প্ৰাণ-উদবোধনের বাজ করেছি। ধারা কোনো কাজই করেন না তারা অবজার সঙ্গে জিজ্ঞাসা করতে পারেন, এতে কতটুকু কাজই বা হবে। স্বীকার করতেই