পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মানুষের ধর্ম Ye SR G চেষ্টা করে “আমি কী— আমার চরম মূল্য কোথায় ।” বলা বাহুল্য, উত্তর দেবার উপলক্ষে পূজার বিষয়কল্পনায় অনেক সময়ে তার এমন চিত্ত প্ৰকাশ পায় বুদ্ধিতে যা অন্ধ, শ্রেয়োনীতিতে যা গৰ্হিত, সৌন্দর্যের আদর্শে যা বীভৎস । তাকে বলব ভ্রান্ত উত্তর এবং মানুষের কল্যাণের জন্যে সকলরকম ভ্রমকেই যেমন শোধন করা দরকার এখানেও তাই । এই ভ্ৰমের বিচার মানুষেরই শ্রেয়োবুদ্ধি থেকেই, মানুষের দেবতার শ্রেষ্ঠতার বিচার মানুষেরই পূর্ণতার আদর্শ থেকে । জীবসৃষ্টির প্রকাশপর্যায়ে দেহের দিকটাই যখন প্রধান ছিল তখন দেহসংস্থানঘটিত ভ্ৰম বা অপূর্ণতা নিয়ে অনেক জীবের ধ্বংস বা অবনতি ঘটেছে । জীবসৃষ্টির প্রকাশে মানুষের মধ্যে যখন “আমি” এসে দান্ডালো তখন এই “আমি” সম্বন্ধে ভুল করলে দৈহিক বিনাশের চেয়ে বড়ো বিনাশ । এই আমিকে নিয়ে ভূল কোথায় ঘটে সে প্রশ্নের একই উত্তর দিয়েছেন আমাদের সকল মহাপুরুষ । তারা এই অদ্ভুত কথা বলেন, যেখানে আমিকে না-আমির দিকে জানতে বাধা পাই, তাকে অহং-বেড়ায় বিচ্ছিন্ন সীমাবদ্ধ করে দেখি । এক আত্মলোকে সকল আত্মার অভিমুখে আত্মার সত্য ; এই সত্যের আদর্শেই বিচার করতে হবে মানুষের সভ্যতা, মানুষের সমস্ত অনুষ্ঠান, তার রাষ্ট্রতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মতন্ত্র- এর থেকে যে পরিমাণে সে ভ্ৰষ্ট সেই পরিমাণে সে বর্বর । মানুষের দায় মহামানবের দায়, কোথাও তার সীমা নেই । অন্তহীন সাধনার ক্ষেত্রে তার বা জন্তুদের বাস ভূমণ্ডলে, মানুষের বাস সেইখানে যাকে সে বলে তার দেশ । দেশ কেবল ভৌমিক নয়, দেশ মানসিক । মানুষে মানুষে মিলিয়ে এই দেশ জ্ঞানে জ্ঞানে, কর্মে কর্মে । যুগযুগান্তরের প্রবাহিত চিন্তাধারায় প্রীতিধারায় দেশের মন ফলে শস্যে সমৃদ্ধ । বহু লোকের আত্মত্যাগে দেশের গৌরব সমুজ্জ্বল । যে-সব দেশবাসী অতীতকালের তারা বস্তুত বাস করতেন। ভবিষ্যতে । তাদের ইচ্ছার গতি কর্মের গতি ছিল আগামীকালের অভিমুখে । তাদের তপস্যার ভবিষ্যৎ আজি বর্তমান হয়েছে আমাদের মধ্যে, কিন্তু আবদ্ধ হয় নি । আবার আমরাও দেশের ভবিষ্যতের জন্য বর্তমানকে উৎসর্গ করছি । সেই ভবিষ্যৎকে ব্যক্তিগত রূপে আমরা ভোগ করব না । যে তপস্বীরা অন্তহীন ভবিষ্যতে বাস করতেন, ভবিষ্যতে র্যাদের আনন্দ, র্যাদের আশা, যাদের গৌরব, মানুষের সভ্যতা তাদেরই রচনা । তাদেরই স্মরণ করে মানুষ আপনাকে জেনেছে অমৃতের সন্তান, বুঝেছে যে, তার সৃষ্টি, তার চরিত্র, মৃত্যুকে পেরিয়ে । মৃত্যুর মধ্যে গিয়ে র্যারা অমৃতকে প্রমাণ করেছেন তাদের দানেই দেশ রচিত । ভাবীকালবাসীরা, শুধু আপন দেশকে নয়, সমস্ত পৃথিবীর লোককে অধিকার করেছেন । তাদের চিন্তা, তাদের কর্ম, জাতিবর্ণ নিবিচারে সমস্ত মানুষের । সবাই তাদের সম্পদের উত্তরাধিকারী । তারাই প্ৰমাণ করেন, সব মানুষকে নিয়ে, সব মানুষকে অতিক্রম করে, সীমাবদ্ধ কালকে পার হয়ে এক-মানুষ বিরাজিত ! সেই মানুষকেই প্ৰকাশ করতে হবে, শ্রেষ্ঠ স্থান দিতে হবে বলেই মানুষের বাস দেশে । অর্থাৎ, এমন জায়গায় যেখানে প্ৰত্যেক মানুষের বিস্তার খণ্ড খণ্ড দেশকলপাত্ৰ ছাড়িয়ে- যেখানে মানুষের বিদ্যা, মানুষের সাধনা সত্য হয় সকল কালের সকল মানুষকে নিয়ে । ভবিষ্যৎকাল অসীম, অতীতকালও তাই । এই দুই দিকে মানুষের মন প্রবলভাবে আকৃষ্ট । পুরুষ এবেদং সৰ্বং যদভূতং যচ্চ ভবাম । যা ভূত, যা ভাবী, এই-সমস্তই সেই পুরুষ । মানুষ ভাবতে ভালোবাসে, কোনো-এক কালে তার শ্রেষ্ঠতার আদর্শ পূর্বেই বিষয়ীকৃত । তাই প্ৰায় সকলজাতীয় মানুষের পুরাণে দেখা যায় সত্যযুগের কল্পনা অতীতকালে । সে মনে করে, যে আদর্শের উপলব্ধি অসম্পূর্ণ কোনাে-এক দূরকালে তা পরিপূর্ণ অখণ্ড বিশুদ্ধ আকারে । সেই পুরাণের বৃত্তান্তে মানুষের এই আকাঙক্ষাটি প্ৰকাশ পায় যে, অনাদিতে যা প্ৰতিষ্ঠিত অসীমে তাই প্ৰমাণিত হতে থাকবে । যে গানটি পূর্বেই সম্পূর্ণ রচিত গাওয়ার দ্বারাই সেটা ক্রমশ প্রকাশমান, এও তেমনি । মনুষ্যত্বের আদর্শ এক কোটিতে সমাপ্ত, আর-এক কোটিতে উপলভ্যমান । এখনকার দিনে মানুষ অতীতকালে সত্যযুগকে মানে না, তবু তার সকলপ্রকার শ্ৰেয়োনুষ্ঠানের মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে অনাগতকালে সত্যযুগের প্রত্যাশা ৷ তাকে সার্থক করবার জন্যে প্ৰাণ দিতে পারে, এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই । অগোচর ভবিষ্যতেই