পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মানুষের ধর্ম Vo O S0 পাই, তখন আমার এই আমি-বোধই বৃহৎ হয়, গভীর হয়, প্রসারিত হয় আপন সীমাতীত সত্যে । তখন অনুভব করি, এক বৃহৎ আনন্দের অন্তর্গত আমার আনন্দ । অন্য কোনো গ্রন্থে এ সম্বন্ধে যে উপমা ব্যবহার করেছি। এখানে তার পুনরাবৃত্তি করতে চাই । একখণ্ড লোহার রহস্যভেদ করে বৈজ্ঞানিক বলেছেন, সেই টুকরোটি আর-কিছুই নয়, কতকগুলি বিশেষ ছন্দের বিদ্যুৎমণ্ডলীর চিরাচঞ্চলতা । সেই মণ্ডলীর তড়িৎকণাগুলি নিজেদের আয়তনের অনুপাতে পরস্পরের থেকে বহু দূরে দূরে অবস্থিত । বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে যা ধরা পড়েছে সহজ দৃষ্টিতে যদি সেইরকম দেখা যেত, তা হলে মানবমণ্ডলীতে প্ৰত্যেক ব্যক্তিকে যেমন পৃথক দেখি তেমনি তাদেরও দেখতুম । এই অণুগুলি যত পৃথকই হােক, এদের মধ্যে একটা শক্তি কাজ করছে । তাকে শক্তিই বলা যাক । সে সম্বন্ধশক্তি, ঐক্যশক্তি, সে ঐ লৌহখণ্ডের সংঘশক্তি । আমরা যখন লোহা দেখছি তখন বিদ্যুৎকণা দেখছি নে, দেখছি সংঘরাপকে । বস্তুত, এই-যে লোহার প্রতীয়মান রূপ এ একটা প্ৰতীক । বস্তুটা পরমার্থত যা, এ তা নয় । অন্যবিধ দৃষ্টি যদি থাকে। তবে এর প্রকাশ হবে অন্যবি” । দশ-টাকার নোট পাওয়া গেল, বিশেষ রাজত্বে তার বিশেষ মূল্য । একে দেখবামাত্র যে জানে এখ। এই কাগজখানা স্বতন্ত্র দশ-সংখ্যক টাকার সংঘরাপ, তা হলেই সে একে ঠিক জানে । কাগজখানা ঐ সংঘের প্রতীক । আমরা যাকে চোখে দেখছি লোহা সেও প্ৰকাশ করছে সেই সংঘকে যাকে চোখে দেখা যায় না, দেখা যায় স্কুল প্রতীকে । তেমনি ব্যক্তিগত মানুষগুলির মধ্যে দেশকালের ব্যবধান যথেষ্ট, কিন্তু সমস্ত মানুষকে নিয়ে আছে একটি বৃহৎ এবং গভীর ঐক্য । সেই ইন্দ্ৰিয়বোধ্যাতীত ঐক্য সাংখ্যিক সমষ্টিকে নিয়ে নয়, সমষ্টিকে অতিক্রম করে । সেই হচ্ছে সমস্তের এক গৃঢ় আত্মা, একধৈবানুদ্রষ্টব্যঃ, কিন্তু বহুধাশক্তিযোগে তার প্রকাশ । সমস্ত মানুষের মধ্যে সেই এক আত্মাকে নিজের মধ্যে অনুভব করবার উদার শক্তি র্যারা পেয়েছেন তাদেরই তো বলি মহাত্মা, তারাই তো সর্বমানবের জন্যে প্ৰাণ দিতে পারেন । তারাই তো এই এক গৃঢ় আত্মার প্রতি লক্ষ করে বলতে পারেন, তদোতং প্ৰেয়ঃ পুত্ৰাৎ প্রেয়ো বিত্তাৎ প্রেয়োহন্যস্মাৎ সর্বস্মাদ অন্তরতরং যদয়মাত্মা— তিনি পুত্রের চেয়ে প্রিয়, বিত্তের চেয়ে প্ৰিয়, অন্য-সকল হতে প্ৰিয়, এই আত্মা যিনি অন্তরতর । বৈজ্ঞানিক এই কথা শুনে ধিককার দেন, বলেন, দেবতাকে প্রিয় বললে দেবতার প্রতি মানবিকতা আরোপ করা হয় । আমি বলি, মানবত্ব আরোপ করা নয়, মানবত্ব উপলব্ধি করা । মানুষ আপন মানবিকতারই মাহাত্ম্যবোধ অবলম্বন করে আপনি দেবতায় এসে পৌচেছে । মানুষের মন আপন দেবতায় আপন মানবত্বের প্রতিবাদ করতে পারে না । করা তার পক্ষে সত্যই নয় । ঈথারের কম্পনে মানুষ আলোকত্ব আরোপ করে না, তাকে স্বতই আলোকরূপে অনুভব করে, আলোকরূপেই ব্যবহার করে, করে ফল পায়, এও তেমনি । পরমমানবিক সত্তাকে পেরিয়ে গিয়েও পরমজাগতিক সত্তা আছে। সূর্যলোককে ছাড়িয়ে যেমন আছে নক্ষত্ৰলোক । কিন্তু, যার অংশ এই পৃথিবী, যার উত্তাপে পৃথিবীর প্রাণ, যার যোগে পৃথিবীর চলাফেরা, পৃথিবীর দিনরাত্রি, সে একান্তভাবে এই সূর্যলোক । জ্ঞানে আমরা নক্ষত্ৰলোককে জানি, কিন্তু জ্ঞানে কর্মে আনন্দে দেহমানে সর্বতোভাবে জানি এই সূর্যলোককে । তেমনি জাগতিক ভূমা আমাদের জ্ঞানের বিষয়, মানবিক ভূমা আমাদের সমগ্ৰ দেহ,মন ও চরিত্রের পরিতৃপ্তি ও পরিপূর্ণতার বিষয় । আমাদের ধর্মশ্চি কর্মচ, আমাদের ঋতং সত্যং, আমাদের ভুতং ভবিষ্যৎ সেই সত্তারই অপর্যাপ্তিতে । মানবিক সত্তাকে সম্পূর্ণ ছাড়িয়ে যে নৈর্ব্যক্তিক জাগতিক সত্তা, তাকে প্রিয় বলা বা কোনো-কিছুই বলার কোনো অর্থ নেই। তিনি ভালো-মন্দ সুন্দর-অসুন্দরের ভেদ - বর্জিত । তার সঙ্গে সম্বন্ধ নিয়ে পাপপুণ্যের কথা উঠতে পারে না । অতীতিব্ৰুবতোহন্যত্র কথং তদুপলভ্যতে । তিনি আছেন, এ ছাড়া তাকে কিছুই বলা চলে না। মানবমনের সমস্ত লক্ষণ সম্পূর্ণ লোপ করে দিয়ে সেই নির্বিশেষে মগ্ন হওয়া যায়, এমন কথা শোনা গেছে । এ নিয়ে তর্ক চলে না । মন-সমেত সমস্ত সত্তার সীমানা কেউ একেবারেই ছাড়িয়ে গেছে কি না, আমাদের মন নিয়ে সে কথা নিশ্চিত বলব। কী করে । আমরা