পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মানুষের ধর্ম \U8 و\S20 সেখানে সর্বকালের সর্বমানুষের পূজা মিলতে পারে না । মানুষের ভক্তিকে জাতিতে জাতিতে প্ৰথায় প্রথায় সেই পূজা বিচ্ছিন্ন করে, তার ঐতিহাসিক গণ্ডিগুলি সংকীর্ণ । কিন্তু, তাদের বিরুদ্ধ-সম্প্রদায়েরও দেবতা প্ৰতিমার মতোই বাইরে অবস্থিত, নানাপ্রকার অমানুষিক বিশেষণে লক্ষণে সজ্জিত, শুধু তাই নয়, বিশেষ জাতির ঐতিহাসিক কার্যকলাপে জড়িত ও কাল্পনিক কাহিনী দ্বারা দৈশিক ও কালিক বিশেষত্ব-গ্ৰস্ত । এই পৌত্তলিকতা সূক্ষ্মতর উপাদানে রচিত বলেই নিজেকে অপৌত্তলিক বলে গর্ব করে । বৃহদারণ্যক এই বাহ্যিকতাকেও হীন বলে নিন্দা করেছেন । তিনি বলেন, যে দেবতাকে আমার থেকে পৃথক করে বাইরে স্থাপন করি তাকে স্বীকার করার দ্বারাই নিজেকে নিজের সত্য থেকে দূরে সরিয়ে দিই । এমনতরো কথায় একটা ক্রুদ্ধ কলরব উঠতে পারে। তবে কি মানুষ নিজেকে নিজেই পূজা করবে। নিজেকে ভক্তি করা কি সম্ভব । তা হলে পূজা-ব্যাপারকে তো বলতে হবে অহংকারের বিপুলীকরণ । একেবারে উলটাে । অহংকে নিয়েই অহংকার । সে তো পশুও করে । অহং থেকে বিযুক্ত আত্মায় । ভূম্যার উপলব্ধি একমাত্র মানুষের পক্ষেই সাধ্য। কেননা মানুষের পক্ষে তাই সত্য। ভূমা- আহারে বিহারে আচারে বিচারে ভোগে নৈবেদ্যে মস্ত্রে তন্ত্রে নয় । ভূমা— বিশুদ্ধ জ্ঞানে, বিশুদ্ধ প্রেমে, বিশুদ্ধ কর্মে । বাইরে দেবতাকে রেখে স্তবে অনুষ্ঠানে পূজোপচারে শাস্ত্রপাঠে বাহ্যিক বিধিনিষেধ-পালনে উপাসনা করা সহজ, কিন্তু আপনার চিন্তায়, আপনার কর্মে, পরম মানবকে উপলব্ধি ও স্বীকার করা সব চেয়ে কঠিন সাধনা । সেইজন্যেই কথিত আছে, নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ । তারা সত্যকে অন্তরে পায় না। যারা অন্তরে দুর্বল । অহংকারকে দূর করতে হয়, তবেই অহংকে পেরিয়ে আত্মাতে পৌছতে পারি । যা আত্মা অপহতপাপ্না বিজরো বিমৃত্যুর্কিশোকোহবিজিঘৎ সোহপিপাসঃ সত্যকামঃ সত্যসংকল্পঃ সোহন্বেষ্টব্যঃ সি বিজিজ্ঞাসিতব্যঃ । & আমার মধ্যে যে মহান আত্মা আছেন, যিনি জরামৃত্যশোক-ক্ষুধাতৃষ্ণার অতীত, যিনি সত্যকাম, সত্যসংকল্প, তাকে অন্বেষণ করতে হবে, তাকে জানতে হবে । “মনের মানুষ মনের মাঝে করো অন্বেষণ ” এই—যে তাকে সন্ধান করা, তাকে জানা, এ তো বাইরে জানা, বাইরে পাওয়া নয় ; এ যে আপন অন্তরে আপনি হওয়ার দ্বারা জানা, হওয়ার দ্বারা পাওয়া । প্ৰজ্ঞানেনৈনমাপুয়াৎ- যুক্তিতর্কের যোগে বাহ্যজ্ঞানের বিষয়কে যেমন করে জানি এ তো তেমন করে জানা নয়, অন্তরে হওয়ার দ্বারা জানা । নদী সমুদ্রকে পায় যেমন করে, প্রতিক্ষণেই সমুদ্র হতে হতে । এক দিকে সে ছোটাে নদী, আর-এক দিকে সে বৃহৎ সমুদ্র । সেই হওয়া তার পক্ষে সম্ভব, কেননা সমুদ্রের সঙ্গে তার স্বাভাবিক ঐক্য ; বিচ্ছেদের ভিতর দিয়ে সেই ঐক্য । জীবধর্ম যেন উচু পাড়ির মতো জন্তুদের চেতনাকে ঘিরে আটক করেছে। মানুষের আত্মা জীবধর্মের পাড়ির ভিতর দিয়ে তাকে কেবলই পেরিয়ে চলেছে, মিলেছে আত্মার মহাসাগরে, সেই সাগরের যোগে সে জেনেছে আপনাকে । যেমন নদী পায় আপনাকে যখন সে বৃহৎ জলরাশিকে আপন করে ; নইলে সে থাকে বদ্ধ হয়ে, বিল হয়ে, জলা হয়ে । তাই বাউল মানুষকে বলেছে, “তোরই ভিতর অতল সাগর।” পূর্বেই বলেছি ; মানুষ আপন ব্যক্তিগত সংস্কারকে পার হয়ে যে জ্ঞানকে পায়, যাকে বলে বিজ্ঞান, সেই জ্ঞান নিখিল মানবের, তাকে সকল মানুষই স্বীকার করবে, সেইজন্যে তা শ্ৰদ্ধেয় । তেমনি মানুষের মধ্যে স্বার্থগত আমির চেয়ে যে বড়ো আমি সেই-আমির সঙ্গে সকলের ঐক্য, তার কর্ম সকলের কর্ম । একলা আমির কর্মই বন্ধন, সকল আমির কর্ম মুক্তি। আমাদের বাংলাদেশের বাউল বলেছে একবার দিব্যচক্ষু খুলে গেলে দেখতে পাবি সর্বঠাই । সেই মনের মানুষ সকল মনের মানুষ, আপন মনের মধ্যে তাকে দেখতে পেলে সকলের মধ্যেই তাকে পাওয়া হয় । এই কথাই উপনিষদ বলেছেন, যুক্তাত্মানঃ সর্বমেবাবিশন্তি । বলেছেন, তং বোদ্যং