পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মানুষের ধর্ম V386 থাকে- মিল নেই বলেই এই নিয়ে তাদের উত্তেজনা উগ্রতা এত বেশি । রাগারগির দ্বারা সত্যের প্ৰতিবাদ, অগ্নিশিখাকে ছুরি দিয়ে বেধবার চেষ্টার মতো । সেই ছুরি সত্যকে মারতে পারে না, মারে মানুষকে । তবু সেই বিভীষিকার সামনে দাড়িয়েই বলতে হবে- | সব সঁাচ মিলৈ সো সঁচ হৈ না মিলৈ সো কুঁঠ । একদা যেদিন কোনো—একজন মাত্র বৈজ্ঞানিক বললেন, পৃথিবী সূর্যের চার দিকে ঘুরছে, সেদিন সেই একজন মাত্র মানুষই বিশ্বমানুষের বুদ্ধিকে প্রকাশ করেছেন । সেদিন লক্ষ লক্ষ লোক সে কথায় ক্রুদ্ধ ; তারা ভয় দেখিয়ে জোর করে বলতে চেয়েছে, সূৰ্যই পৃথিবীর চার দিকে ঘুরছে । তাদের সংখ্যা মানবকে অস্বীকার করলে । সেদিন অসংখ্য বিরুদ্ধবাদীর মাঝখানে একলা দাড়িয়ে কে বলতে পেরেছে সোহহং, অর্থাৎ, আমার জ্ঞান আর মানবভুমার জ্ঞান এক । তিনিই বলেছেন র্যাকে সেদিন বিপুল জনসংঘ সত্য প্ৰত্যাখ্যান করাবার জন্যে প্ৰাণান্তিক পীড়ন করেছিল । যদি লক্ষ লক্ষ লোক বলে, কোটি যোজন দূরে কোনো বিশেষ গ্রহনক্ষত্রের সমবায়ে পৃথিবীর কোনো-একটি প্রদেশের জলধারায় এমন অভৌতিক জাদুশক্তির সঞ্চার হয় যাতে স্নানকারীর নিজের ও পূর্বপুরুষের আন্তরিক পাপ যায় ধুয়ে, তা হলে বলতেই হবেসব সঁাচ মিলৈ সো সঁচ হৈ না মিলৈ সো কুঁঠি । বিশ্বের বুদ্ধি এ বুদ্ধির সঙ্গে মিলল না । কিন্তু যেখানে বলা হয়েছে, অস্তুিগাত্ৰাণি শুধ্যান্তি মনঃ সত্যেন শুধ্যাতি- জল দিয়ে কেবল দেহেরই শোধন হয়, মনের শোধন হয়। সত্যে, সেখানে বিশ্বমানবমনের সম্মতি পাওয়া যায় । কিংবা যেখানে বলা হয়েছে কৃত্বা পাপং হি সন্তাপ্য তস্মাৎ পাপাৎ প্ৰমুচ্যতে | নৈবং কুৰ্যম পুনরিতি নিবৃত্ত্যা পূয়তে তু সঃ । পাপ করে সন্তপ্ত হলে সেই সন্তাপ থেকেই পাপের মােচন হয়, “এমন কাজ আর করব না বলে নিবৃত্ত হলেই মানুষ পবিত্র হতে পারে— সেখানে এই বলতেই মানুষ আপন বুদ্ধিতে স্বীকার করে বিশ্বমনের প্রজ্ঞাকে । তং হি দেবম আত্মবুদ্ধিপ্ৰকাশম— সেই দেবতাকে আমাদের আত্মায় জানি যিনি আত্মবুদ্ধিপ্রকাশক । আমার মন আর বিশ্বমন একই, এই কথাই সত্যসাধনার মূলে, আর ভাষান্তরে এই কথাই সোহহম । একদিন ব্ৰাহ্মণ রামানন্দ তার শিষ্যদের কাছ থেকে চলে গিয়ে আলিঙ্গন করলেন নাভা চণ্ডালকে, মুসলমান জোলা কবীরকে, রবিদাস চামারকে । সেদিনকার সমাজ তাকে জাতিচ্যুত করলে । কিন্তু, তিনি একলাই সেদিন সকলের চেয়ে বড়ো জাতিতে উঠেছিলেন যে জাতি নিখিল মানুষের । সেদিন ব্ৰাহ্মণামণ্ডলীর ধিককারের মাঝখানে একা দাড়িয়ে রামানন্দই বলেছিলেন সোহহম ; সেই সত্যের শক্তিতেই তিনি পার হয়ে গিয়েছিলেন সেই ক্ষুদ্র সংস্কারগত ঘূণাকে যা নিষ্ঠুর হয়ে মানুষে মানুষে ভেদ ঘটিয়ে সমাজস্থিতির নামে সমাজধর্মের মূলে আঘাত করে । একদিন যিশু খৃস্ট বলেছিলেন, “সোহহম । আমি আর আমার পরমপিতা একই ।” কেননা, তার যে শ্ৰীতি, যে কল্যাণবুদ্ধি সকল মানুষের প্রতি সমান প্রসারিত সেই শ্ৰীতির আলোকেই আপনি অহংসীমাকে ছাড়িয়ে পরম মানবের সঙ্গে তিনি আপনি অভেদ দেখেছিলেন । বুদ্ধদেব উপদেশ দিলেন, সমস্ত জগতের প্রতি বাধাশূন্য হিংসাশূন্য শত্ৰুতাশূন্য মানসে অপরিমাণ মৈত্রী পোষণ করবে। দাড়াতে বসতে চলতে শুতে, যাবৎ নিদ্রিত না হবে, এই মৈত্রীস্মৃতিতে অধিষ্ঠিত থাকবে- একেই বলে ব্ৰহ্মবিহর । এতবড়ো উপদেশ মানুবকেই দেওয়া চলে । কেননা, মানুষের মধ্যে গভীর হয়ে আছে সোহহংতত্ত্ব । সে কথা বুদ্ধদেব নিজের মধ্য থেকেই জেনেছেন, তাই বলেছেন, অপরিমাণ প্রেমেই আপনার অন্তরের অপরিমেয় সত্যকে মানুষ প্ৰকাশ করে ।