পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী - ما 8 ما অথর্ববেদ বলেন, তস্মাদ বৈ বিদ্বান পুরুষমিদং ব্ৰহ্মেতি মন্যতে— যিনি বিদ্বান তিনি মানুষকে তার প্রত্যক্ষের অতীত বৃহৎ বলেই জানেন । সেইজন্যে তিনি তার কাছে প্রত্যাশা করতে পারেন দুঃসাধ্য কর্মকে, অপরিমিত ত্যাগকে । যে পুরুষে ব্ৰহ্ম বিদুস্তে বিদ্যুঃ পরমেষ্ঠিনম— যারা ভূমাকে জানেন মানুষে তারা জানেন পরম দেবতাকেই । সেই মানবদেবতাকে মানুষের মধ্যে জেনেছিলেন বলেই বুদ্ধদেব উপদেশ দিতে পেরেছিলেন— মাতা যথা নিয়ং পুত্তং আয়ুসা. এক পুত্তমন্নুরকখে, এবম্পি সব্বভুতেষু মানসম্ভাবয়ে অপরিমাণং। মা যেমন আপন আয়ু ক্ষয় করেই নিজের একমাত্র পুত্রকে রক্ষা করে তেমনি সকল প্ৰাণীর প্রতি মনে অপরিমাণ দয়াভাব জন্মাবে। মাথা গণে বলব না ক’জন এই উপদেশ পালন করতে পারে । সেই গণনায় নয়। সত্যের বিচার । মানুষের অসীমতা যিনি নিজের মধ্যে অনুভব করেছিলেন তাকে অপেক্ষা করতে হয় নি মাথা গোনবার । তিনি অসংকোচে মানুষের মহামানবকে আহবান করেছিলেন ; বলেছিলেন, “অপরিমাণ ভালোবাসায় প্ৰকাশ করো আপনার অন্তরে ব্ৰহ্মাকে ৷” এই বাণী অসংকোচে সকলকে শুনিয়ে তিনি মানুষকে শ্রদ্ধা করেছিলেন । আমাদের দেশে এমন আত্মাবমাননার কথা প্ৰায়ই শুনতে পাওয়া যায় যে, সোহংতত্ত্ব সকলের নয়, কেবল তাদেরই র্যারা ক্ষণজন্মা । এই বলে মানুষের অধিকারকে শ্রেষ্ঠ ও নিকৃষ্ট -ভেদে সম্পূৰ্ণ বিচ্ছিন্ন করে নিশ্চেষ্ট নিকৃষ্টতাকে আরাম দেওয়া হয়েছে । আমাদের দেশে যাদের অস্ত্যজ বলা হয় তারা যেমন নিজের হোয়তাকে নিশ্চল করে রাখতে কুষ্ঠিত হয় না তেমনি এ দেশে অগণ্য মানুষ আপন কনিষ্ঠ অধিকার নিঃসংকোচে মেনে নিয়ে মৃঢ়তাকে, চিত্তের ও ব্যবহারের দীনতাকে, বিচিত্র আকারে প্রকাশ করতে বাধা পায় না । কিন্তু, মানুষ হয়ে জন্মেছি, ললাটের লিখনে নিয়ে এসেছি সোহহম— এই বাণীকে সার্থক করবার জন্যেই আমরা মানুষ । আমাদের একজনেরও অগৌরব সকল মানুষের গৌরব ক্ষুন্ন করবে। যে সেই আপন অধিকারকে খর্ব করে সে নিজের মধ্যে র্তার অসম্মান করে যিনি কর্মধ্যক্ষঃ সৰ্ব্বভুতাধিবাসঃ সাক্ষী- যিনি সকলের কর্মের অধ্যক্ষ, সকলের যিনি অন্তরতম সাক্ষী, সকলের মধ্যে র্যার বাস । পূর্বেই দেখিয়েছি। অথর্ববেদ বলেছেন, মানুষ প্ৰত্যক্ষত যা পরমার্থত তার চেয়ে বেশি, সে আছে অসীম উদ্যবৃত্তের মধ্যে । সেই উদ্যবৃত্তেই মানুষের যা কিছু শ্রেষ্ঠ, তার ঋতং সত্যং তপো রাষ্ট্রং শ্রমো ধর্মশ্চি কর্ম চ | স্থূলদ্রব্যময়ী এই পৃথিবী । তাকে বহুদূর অতিক্রম করে গেছে তার বায়ুমণ্ডল । সেই অদৃশ্য বায়ুলোকের ভিতর দিয়ে আসছে তার আলো, তার বর্ণচ্ছটা, বইছে তার প্রাণ, এরই উপর জমছে তার মেঘ, ঝরিছে তার বারিধারা, এইখানকার প্রেরণাতেই তার অঙ্গে অঙ্গে রূপধারণ করছে পরামরহস্যময় সৌন্দৰ্য- এইখান থেকেই আসছে পৃথিবীর যা শ্রেষ্ঠ, পৃথিবীর শ্ৰী, পৃথিবীর প্রাণ। এই বায়ুমণ্ডলেই পৃথিবীর সেই জানলা খোলা রয়েছে যেখানে নক্ষত্ৰলোক থেকে অন্ধকার পেরিয়ে প্রতি রাত্রে দূত আসছে আত্মীয়তার জ্যোতির্ময় বার্তা নিয়ে । এই তার প্রসারিত বায়ুমণ্ডলকেই বলা যেতে পারে পৃথিবীর উদ্যবৃত্ত ভাগের আত্মা, যেমন পূর্ণ মানুষকে বলা হয়েছে, ত্রিপাদস্যামৃতম— তার এক অংশ প্ৰত্যক্ষ, বাকি তিন অংশ অমৃতরূপে তাকে ছাড়িয়ে আছে উন্ধেৰ্ব্ব । এই সূক্ষ্মবায়ুলোেক ভূলোকের একান্ত আপনারই বলে সম্ভব হয়েছে পৃথিবীর ধূলিস্তরে এত বিচিত্ৰ ঐশ্বৰ্যবিস্তার যাব। মূল্য ধূলির মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি । উপনিষদ বলেন, অসভূতি ও সভৃতিকে এক করে জানলেই তবে সত্য জানা হয় । অসভৃতি যা অসীমে অব্যক্ত, সভৃতি যা দেশে কালে অভিব্যক্ত । এই সীমায় অসীমে মিলে মানুষের সত্য সম্পূর্ণ। মানুষের মধ্যে যিনি অসীম তাকে সীমার মধ্যে জীবনে সমাজে ব্যক্ত করে তুলতে হবে । অসীম সত্যকে বাস্তব সত্য করতে হবে । তা করতে গেলে কর্ম চাই । ঈশোপনিষদ তাই বলেন, “শত বৎসর তোমাকে