পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মানুষের ধর্ম vU98 বাচতে হবে, কম তোমার না করলে নয় ।” শত বৎসর বাচাকে সার্থক করো কমো- এমনতরো কর্মে যাতে প্ৰত্যয়ের সঙ্গে, প্রমাণের সঙ্গে, বলতে পারা যায় সোহহম । এ নয় যে, চোখ উলটিয়ে, নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকতে হবে মানুষের থেকে দূরে । অসীম উদ্যবৃত্ত থেকে মানুষের মধ্যে যে শ্রেষ্ঠতা সঞ্চারিত হচ্ছে সে কেবল সত্যং ঋতং নয়, তার সঙ্গে আছে। রাষ্ট্রং শ্রমো ধৰ্মশ্চ কর্ম চ ভূতং ভবিষ্যৎ । এই—যে কর্ম, এই—যে শ্ৰম, যা জীবিকার জন্যে নয়, এর নিরস্তর উদ্যম কোন সত্যে । কিসের জোরে মানুষ প্রাণকে করছে তুচ্ছ, দুঃখকে করছে বরণ, অন্যায়ের দুর্দান্ত প্ৰতাপকে উপেক্ষা করছে বিনা উপকরণে, বুক পেতে নিচ্ছে অবিচারের দুঃসহ মৃত্যশেল । তার কারণ, মানুষের মধ্যে শুধু কেবল তার প্ৰাণ নেই, আছে তার মহিমা । সকল প্রাণীর মধ্যে মানুষেরই মাথা তুলে বলবার অধিকার আছে, সোহহম । সেই অধিকার জাতিবর্ণনির্বিচারে সকল মানুষেরই । ক্ষিতিমোহনের অমূল্য সংগ্রহ থেকে বাউলের এই বাণী পাই— জীবে জীবে চাইয়া দেখি সবই যে তার অবতার, ও তুই নুতন লীলা কী দেখাবি যার নিত্যলীলা চমৎকার । প্ৰতিদিনই মানব-সমাজে এই লীলা । অসংখ্য মানুষ জ্ঞানে প্রেমে ত্যাগে নানা আকারেই অপরিমেয়কে প্রকাশ করছে । ইতিহাসে তাদের নাম ওঠে না, আপন প্ৰাণ থেকে মানুষের প্রাণপ্ৰবাহে তাবা ঢেলে দিয়ে যায় তারই অমিততেজ যশ্চােয়মস্মিন তেজোময়োহমূতময়ঃ পুরুষঃ সর্বানুভূঃ- যিনি এই আত্মার মধ্যেই তেজোময় অমৃতময় পুরুষ, যিনি সমস্তই অনুভব করেন, যেমন আকাশব্যাপী তেজকে উদ্ভিদ আপন প্ৰাণের সামগ্ৰী করে নিয়ে পৃথিবীর প্রাণলোকে উৎসগ করে । উদ্ভিদের ভিতর দিয়ে বিশ্বতেজ যদি প্রাণবস্তুতে নিয়ত পরিণত না হতে পারত তা হলে জীবলোক যেমন মরুশয্যাশায়ী হত, তেমনি আমাদের গোচরে-অগোচরে দেশে দেশে কালে-কালে নরনারী নিজের অস্তরস্থিত পরমপুরুষের অমিততেজ যদি কল্যাণে ও প্ৰেমে, জ্ঞানে ও কমে, নিরস্তর সমাজের প্রাণবস্তুতে পরিণত না করত, তা হলে সমাজ সোহহংতত্ত্ববর্জিত হয়ে পশুলোকের সাথে এক হয়ে যেত । তাও নয়, আপনি সত্য হতে স্বলিত হয়ে বঁাচতেই পারত না । ডাক্তার বলেন, মানুষের দেহে পশুরক্ত সঞ্চার করলে তাতে তার প্রাণবৃদ্ধি না হয়ে প্ৰাণনাশ হয় । পশুসমাজ পশুভাবেই চিরদিন বাচতে পারে, মানুষের সমাজ পশু হয়ে বঁাচতেই পারে না । তার্কিক বলবে, নরলোকে তো অনেক পশু আরামেই বেড়ে ওঠে । শরীরে ফোড়াও তো বাড়ে । আশপাশের চেয়ে তার উন্নতি বেশি বৈ কম নয় । সমস্ত দেহে স্বাস্থ্যের গৌরব সেই ফেডাকে যদি ছাড়িয়ে না যায় তা হলে সে মারে এবং মেরে মরে । প্রকৃতিস্থ সমাজ অনেক পাপ সইতে পারে, কিন্তু যখন তার বিকৃতিটাই হয়ে ওঠে। প্ৰধান তখন চিন্তায় ব্যবহারে সাহিত্যে শিল্পকলায় পশুরক্তস্রোত আত্মস্থ করে সমাজ বেশিদিন বঁাচতেই পারে না । বিলাসোন্মত্ত রোম কি আপনি ঐশ্বর্যের মধ্যেই পাকা ফলে কীটের মতো মরে নি। কালিদাস রঘুবংশের যে পতনের ছবি দিয়েছেন সে কি মানুষের জীবনে পশুপ্রবেশের ফলেই না । অথর্ববেদে শুধু কেবল সত্য ও ঋতের কথা নেই, আছে রাষ্ট্রের কথাও । জনসংঘের শ্রেষ্ঠ রূপ প্ৰকাশ করবার জন্যে তার রাষ্ট্র । ছোটো টবের বাইরে বনস্পতি যদি তার হাজার শিকড় মেলতে না পারে তা হলে সে বেঁটে হয়ে, কাঠি হয়ে থাকে। রাষ্ট্রের প্রশস্ত ভূমি না পেলে জনসমূহ পৌরুষবর্জিত হয়ে থাকে। আপনার মধ্যে যে ভূমাকে প্রমাণ করবার দায়িত্ব মানুষের, সমস্ত জাতি বৃহৎ জীবনযাত্রায় তার থেকে বঞ্চিত হলে ইতিহাসে ধিককৃত হয় । সকলের মাঝখানে সকল কালের সম্মুখে উঠে দাড়িয়ে সে বলতে পারে না “ সোহহম”, বলতে পারে না। “আমি আছি আমার মহিমায়, যে আমি কেবল আজকের দিনের জন্য নয়, যার আত্মঘোষণা ভাবীকালের তোরণে তোরণে ধবনিত হতে থাকবে” । ইতিহাসের সেই ধিককার বহুকালের সুপ্তিমগ্ন এসিয়ামহাদেশের বক্ষে দিয়েছে আজ আঘাত ; সকল দিকেই শুনছি জনগণের অন্তর্যামী মহান পুরুষ তামসিকতার বন্দীশালায় শৃঙ্খলে দিয়েছেন ঝংকার, তার প্রকাশের তপোব্দীপ্তি জ্বলে উঠেছে তমসঃ পরস্তাৎ । রব উঠেছে, শৃথন্তু