পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মানুষের ধর্ম '96 ( করেছে তাই ধরা পড়েছে প্ৰভাতসংগীতে । পরবর্তীকালে চিন্তা করে লিখলে তার উপর ততটা নির্ভর করা যেত না । গোড়াতেই বলে রাখা ভালো, প্ৰভাতসংগীত থেকে যে কবিতা শোনাব তা কেবল তখনকার ছবিকে স্পষ্ট দেখাবার জন্যে, কাব্যহিসাবে তার মূল্য অত্যন্ত সামান্য । আমার কাছে এর একমাত্র মূল্য এই যে, তখনকার কালে আমার মনে যে একটা আনন্দের উচ্ছাস এসেছিল তা এতে ব্যক্ত হয়েছে । তার ভাব অসংলগ্ন, ভাষা বঁকাচা, যেন হাৎড়ে হাৎড়ে বলবার চেষ্টা । কিন্তু, “ চেষ্টা বললেও ঠিক হবে না, বস্তুত চেষ্টা নেই তাতে, অস্ফুটবাক মন বিনা চেষ্টায় যেমন করে পারে ভাবকে ব্যক্ত করেছে, সাহিত্যের আদর্শ থেকে বিচার করলে স্থান পাওয়ার যোগ্য সে মোটেই নয় । যে কবিতাগুলো পড়ব তা একটু কুষ্ঠিতভাবেই শোনাব, উৎসাহের সঙ্গে নয় । প্রথম দিনেই যা লিখেছি সেই কবিতাটাই আগে পড়ি । অবশ্য, ঠিক প্ৰথম দিনেরই লেখা কি না, আমার পক্ষে জোর করে বলা শক্ত । রচনার কাল সম্বন্ধে আমার উপর নির্ভর করা চলে না ; আমার কাব্যের ঐতিহাসিক র্যারা তারা সে কথা ভালো জানেন । হৃদয় যখন উদবোল হয়ে উঠেছিল আশ্চর্য ভাবোচ্ছাসে, এ হচ্ছে তখনকার লেখা । একে এখনকার অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে । আমি বলেছি, আমাদের এক দিক অহং আর-একটা দিক আত্মা | অহং যেন খণ্ডাকাশ, ঘরের মধ্যেকার আকাশ, যা নিয়ে বিষয়কর্ম মামলা-মকদ্দমা এই-সব । সেই আকাশের সঙ্গে যুক্ত মহাকাশ, তা নিয়ে বৈষয়িকতা নেই ; সেই আকাশ অসীম, বিশ্বব্যাপী । বিশ্বব্যাপী আকাশে ও খণ্ডাকাশে যে ভেদ, অহং আর আত্মার মধ্যেও সেই ভেদ । মানবত্ব বলতে যে বিরাট পুরুষ তিনি আমার খণ্ডাকাশের মধ্যে ও আছেন । আমারই মধ্যে দুটাে দিক আছে— এক আমাতেই বদ্ধ, আর-এক সর্বত্র ব্যাপ্ত । এই দুই’ই যুক্ত এবং এই উভয়কে মিলিয়েই আমার পরিপূর্ণ সত্তা । তাই বলেছি, যখন আমরা অহংকে একান্তভাবে আঁকড়ে ধরি তখন আমরা মানবধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ি ; সেই মহামানব, সেই বিরাটপুরুষ যিনি আমার মধ্যে রয়েছেন, তার সঙ্গে তখন ঘটে বিচ্ছেদ । জাগিয়া দেখি নু আমি আঁধারে রয়েছি আঁধা, আপনারি মাঝে আমি আপনি রয়েছি বাধা । রয়েছি মগন হয়ে আপনারি কলস্বরে, ফিরে আসে প্ৰতিধ্বনি নিজেরি শ্রবণ-’পরে । এইটেই হচ্ছে অহং, আপনাতে আবদ্ধ, অসীম থেকে বিচ্যুত হয়ে, অন্ধ হয়ে থাকে অন্ধকারের মধ্যে । তারই মধ্যে ছিলুম, এটা অনুভব করলুম। সে যেন একটা স্বপ্নদশা । গভীর— গভীর গুহা, গভীর আঁধার ঘোর, গভীর ঘুমন্ত প্ৰাণ একেলা গাঁহিছে গান, মিশিছে স্বপনগীতি বিজন হাদয়ে মোর । নিদ্রার মধ্যে স্বপ্নের যে-লীলা সত্যের যোগ নেই তার সঙ্গে । অমূলক, মিথ্যা, নানা নাম দিই তাকে । অহং-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ যে জীবন সেটা মিথ্যা। নানা অতিকৃতি দুঃখ ক্ষতি সব জড়িয়ে আছে তাতে । অহং যখন জেগে উঠে আত্মাকে উপলব্ধি করে তখন সে নূতন জীবন লাভ করে । এক সময়ে সেই অহং-এর খেলাঘরের মধ্যে বন্দী ছিলুম। এমনি করে নিজের কাছে নিজের প্রাণ নিয়েই ছিলুম, বৃহৎ সত্যের রূপ দেখি নি । আজি এ প্ৰভাতে রবির কর কেমনে পশিল গুহার আঁধারে । প্ৰভাতপাখির গান !